১৯১৩ তে প্রকাশিত বেণুধর রাজখোয়ার 'Notes on the Sylhetee Dialect' এর উপর
নির্ভর করেই প্রায় সমস্ত অসমিয়া ভাষাবিদ সিলেটিকে অসমিয়ার উপভাষা বলে দাবি
করে থাকেন। প্রখ্যাত অসমিয়া ভাষাবিদ কটন কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. রমেশ
পাঠকও এক্কেবারে সন তারিখ দিয়ে দাবি করেছেন, “চিলেটর ভাষার সৈতে অসমীয়া
ভাষার সম্পর্ক বর্তমান অবস্থাত বিচারিবলৈ যোয়াটো পর্বতত কাছকণী বিচারিবলৈ
যোৱাৰ দরে হ'ব, কারণ বাংলা ভাষাই চিলেটী ভাষার রূপ এনেদরে সলাই পেলাইছে যে
চিলেটী এতিয়া বাংলা ভাষারে আঞ্চলিক রূপ মাথোন। অথচ, ১৯১৩ চনলৈকে চিলেটী
ভাষা অসমীয়া ভাষার সৈতে অদ্ভূৎ ধরণে মিলিছিল। ... ১৯১৩ চনত ওলোয়া বেণুধর
রাজখোয়াৰ Notes on Sylhetee Dialect বোলা গ্রন্থখনৰ পরা তথ্যবোর দিয়া হৈছে।
...” [পৃঃ ১৫৯; উপভাষা বিজ্ঞানের ভূমিকা।] তার মানে ১৯১৩তে যেহেতু
বেনুধর রাজখোয়ার বইটি বেরিয়েছিল সুতরাং ওই পর্যন্ত ভাষাটি অসমিয়া ছিল। তার
পর থেকে একে বাংলা গ্রাস করেছে। এরকম ভাষাগ্রাস করা সম্ভব কিনা, সিলেটির
মধ্যে আদৌ তেমন অস্বাভাবিক কিছু পরিবর্তন হয়েছে কিনা এই সব ভাষাতাত্বিক
প্রশ্ন এক পাশে সরিয়ে রেখেও যে বিপজ্জনক আশঙ্কাটি তার লেখাতেও স্পষ্ট যে
এমন ভাষা তত্ব অহেতুক সাধারণ অসমীয়াদের মনে বাংলা সম্পর্কে এক আতঙ্ককে লালন
করতে সাহায্য করে।
ড. রমেশ পাঠকেরও মন্তব্যেরই মাঝের অংশে রয়েছে, “চিলেটত যি ঘটিছিল বা ঘটিল তেনে ঘটনার প্রক্রিয়া কাছারতো আরম্ভ হৈছে...।”
আমরা কিন্তু এখনো ড. রমেশ পাঠকের মতো এতোটা হতাশ হয়ে মনে করিনা যে সিলেটির
সঙ্গে অসমিয়ার সম্পর্ক সন্ধান করতে যাওয়াটা পর্বতে কচ্ছপের ডিম সন্ধানের
মতো ব্যাপার। এতোটা মৌলিক পরিবর্তন দুই ভাষার কোনোটিরই ঘটেনি। যে বেনুধর
রাজখোয়ার Notes -এর উপর তাদের এতো আস্থা তিনি ওই গ্রন্থটি রচনার তের বছর
পরেই অসম সাহিত্য সভার নবম ধুবড়ি অধিবেশনের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। ওখানে
যা ঘটেছিল তা খুব গৌরব জনক ছিল না। তখনো অসমে অসমিয়া বাঙালি বিভাজন ততটা
স্পষ্ট ছিল না। অসমিয়াদের অনেকেই যেমন সানন্দে বাংলা ভাষা সাহিত্য চর্চা
করতেন, বাঙালিদের অনেকেও তেমনই অসমিয়াদের যেকোনো সাংস্কৃতিক উদ্যোগে সহায়
সম্বল জোটাতেন। সেই সম্পর্কে যারা ভাঙ্গন আনতে চাইছিলেন তাদের অন্যতম
গোয়ালপাড়াতে অনুষ্ঠিত ধুবড়ি অধিবেশনের সভাপতি বেনুধর রাজখোয়া। ড. দেবব্রত
শর্মা লিখছেন, “রাজখোয়াই বঙালি লিখকর কিবা যুক্তির দোষ দেখুয়াই এটা কথা
লিখিছিল। এই কথাত উপস্থিত বঙালী লোক সকলে অতি বেয়া পালে। ইয়ার প্রতিবাদত
বাঙালী ভদ্রলোক এজনে কথা ক'বলোই উঠিলৎ সভাপতি রাজখোয়াই ক'বলৈ নিদি বহুয়াই
থ'লে” [পৃঃ ২৫০, অসমীয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়া আরু জাতীয় জনগোষ্ঠীগত
অনুষ্ঠান সমূহ।] তাতে বেশির ভাগ মানুষ সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলেন। সভা
নেতৃত্ব এতে বিব্রত বোধ করলেন এবং পরদিন যাতে বেনুধর রাজখোয়া নিজের
মন্তব্যের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন তার ব্যবস্থা করেন। খসড়া
বিবৃতিটি সেখানে উপস্থিত বাঙালি নেতৃত্বকে দেখিয়েও অনুমোদন নেয়া হয়েছিল।
কিন্তু সেই বিবৃতি পাঠ করতে গিয়ে বেনুধর রাজখোয়া যা বললেন নিজের ভাষ্যতে
দেবব্রত শর্মা লিখছেন, “বাঙালি সকলে নিজকে জাপানীসকলর লগত তুলনা করার
সম্পর্কে ইতিকিং করি রাজখোয়াই ক'লে জাপানী আরু বাঙালি দুয়ো জাতিয়ে মাছ খায়
বুলিয়েই বাঙালি জাপানী হ'ব নোয়ারে; কারণ তেনেহ'লে মেকুরী আরু বাঙালী দুয়ো
মাছ খায় বাবে বাঙালী মেকুরী হ'ব লাগিব।” এর পরের ঘটনাবলী থামাতে রীতিমতো পুলিশ ডাকতে হয়েছিল। শরৎচন্দ্র গোস্বামী আক্ষেপ করে লিখেছেন , “তার ফল থাকিল বহুদিন প্রকৃততে আজিলৈ। ...সাহিত্য সন্মিলনর পাছত অসমীয়ার বিপক্ষে এটা ডাঙর দল হ'ল।” ( পৃঃ ২৫১; ঐ)।
সুতরাং Notes on Sylhetee Dialect এর লেখক যে অন্যকে অসমিয়ার কাছে টেনে
আনবার কলা খুব ভালো জানতেন না তথ্য তা প্রমাণ করে। যে যুক্তিতে একটু কটু
ভাষাতে বললেও তিনি 'বাঙালী'র 'মেকুরী' হবার সম্ভাবনা নাকচ করছেন সেইসব
যুক্তি কিন্তু তিনি নিজেই ঐ নোট লিখবার বেলা ভুলে বসেছিলেন। বস্তুত, রমেশ
পাঠক যেভাবে লিখেছেন, সিলেটিকে বাংলা ভাষা গ্রাস করেনি। যদিও বা সিলেটির
অসমীয়ার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা ছিল সেই সম্ভাবনার চারা গাছকে মেরে
ফেলার রাজনৈতিক আয়োজনও কিন্তু শুরু হয়েছিল ১৯২৬ থেকেই। সে বছরের অসম বিধান
পরিষদের নির্বাচনেই অন্যতম দাবি ছিল শ্রীহট্টকে অসম থেকে বাদ দেয়া। ত্রিশের
দশকে গোপীনাথ বরদলৈ যখন আসাম এসোসিয়েসন নতুন করে গড়ে তোলেন তখন থেকেই তার
অন্যতম প্রয়াস ছিল সিলেটকে অসম থেকে বের করে দেয়া। এরকম দাবির জন্যেই দেশ
ভাগের সময় একমাত্র অসমেই সিলেটে গণভোট হয়েছিল। আর তাতে সক্রিয় ভূমিকা
নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ। ঐ ঘটনা অসমে থেকে যাওয়া অংশের
সিলেটিদের মনেও যে গভীর বিয়োগান্তক দাগ বসিয়ে দিয়েছে সেই তথ্যকে গোপন করে
সিলেটি কেন বাংলা হয়ে গেল তার দায় বাংলা ভাষার উপর চাপিয়ে দেয়া এক্কেবারেই
ঐতিহাসিক সত্যও নয়, শুভফলদায়কও নয়।