এক সময় পুকুরটি ছিল পুরো জনপদের পানির উৎস,
প্রাণ ও জীবনের স্পন্দন। কিন্তু নানা অনাচারে এখন নষ্ট,
হাজামজা ডোবায় পরিণত হয়েছে। মানুষের তাই কষ্টের সীমা নেই।
বিরাট পুকুরের পাড় ভেঙে অনেক নালা হয়েছে। বাইরের নর্দমার পচা পানি ঢুকে হরদম সেই নালা দিয়ে। পুকুর সংস্কারের উদ্যোগও
ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে পুকুরের সংস্কার না হওয়ায় জনগণের দুর্দশা কাটছে না। বিজ্ঞজন বললেন, আগে পুকুর পাড়ের নালা বা সুড়ঙ্গ বন্ধ করে বাইরের পচা পানি ঢোকা বন্ধ করেন।
তারপর আগাছা, কচুরিপানা পরিষ্কার করেন। আর হাজামজা পানি
সবটুকু সেচে বাইরে ফেলে দেন। অনেক দিন পর সূর্য তার প্রখর রোদ দিয়ে উত্তাপ ছড়াক
পুকুর তলার মাটিতে। দেখবেন বর্ষার নতুন পানিতে পোনা ছাড়লে মাছের ভালো চাষ হচ্ছে।
আর যদি পচা পানির সঙ্গে পুকুর তলার কাদামাটিও সরিয়ে ফেলেন দেখবেন নিচ থেকে স্বচ্ছ
নির্মল পানি বের হচ্ছে ঝরনার মতো। এবার পুকুরের পাড় খুলে দেন। ঝরনার সেই পানি
প্রবাহিত হবে পুরো লোকালয়ে। নতুন জীবনে প্রাণ স্পন্দনে শিহরণ বয়ে যাবে জনপদে। মানুষের ভেতরের যে সত্তা প্রাণ-মন-আত্মাকে নিয়ে
যে মানবসত্তা, তাকে যদি কল্পনা করা হয় পুকুরের সঙ্গে, বলতে হবে বস্তু জগতের নানা অনাচারে মনের পুকুর নষ্ট হয়ে ডোবায় পরিণত হয়েছে। এর
সংস্কারের জন্য প্রথম প্রয়োজন পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের পথে বাইরের পচা দুর্গন্ধময় পানির
প্রবেশ বন্ধ করতে হবে নির্দিষ্ট কিছু দিনের জন্য। এর মধ্যে ভেতরের আবর্জনা,
কচুরিপানা, কাদামাটি তুলে বাইরে ফেলে
দিতে হবে। মুখ বন্ধ রাখতে হবে। পানাহার বর্জন করতে হবে বছরের এক মাস। দিনের বেলা
মানুষকে পথহারা করার শয়তানি হাতিয়ার যৌনতাকে দমন করতে হবে বৈধ স্ত্রীর সংসর্গ
ত্যাগ করে। মিথ্যা কথা ও কাজ বর্জন করার সাধনা করতে হবে দীর্ঘ এক মাস। এভাবে মনের
পুকুরের তলদেশ সম্পূর্ণ পাকসাফ হলে আকাশ থেকে আল্লাহর নূরের তাজাল্লি বিচ্ছুরিত
হবে। মন হয়ে যাবে কলুষতামুক্ত,
গোনাহ মাফ হবে। আল্লাহর রহমতে মনের জমিন সিক্ত হবে। তারপর
ভেতর থেকে আধ্যাত্মিক ঝরনাধারা প্রবাহিত হবে। মন সুন্দর হবে, জীবন মহিমান্বিত হবে। চরিত্রের মাধুরী ছড়িয়ে পড়বে সমাজে। সেই রোজাদারের মারফত
আল্লাহর রহমতের সওগাত অবারিত হবে সমাজের জন্য।
মন ও জীবনকে এভাবে সংস্কার, সাজানোর অপর নাম তাকওয়া। তাকওয়ার জন্যই আল্লাহপাক রমজানের রোজা ফরজ করেছেনথ এ
ঘোষণা পবিত্র কোরআনের। অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় রোজার আলাদা বিশেষত্ব হচ্ছে দীর্ঘ
৩০ দিনের সিয়াম সাধনা বান্দাকে আল্লাহর একেবারে সান্নিধ্যে নিয়ে যায়। হাদিসে
কুদসিতে আল্লাহপাক বলেন, বনি আদমের প্রত্যেক নেক
আমলের সওয়াব দেয়া হবে ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত। আমলের শুদ্ধতা ও নিষ্ঠার অনুপাতে এ
সওয়াব বরাদ্দ। কিন্তু রোজা এর ব্যতিক্রম। আল্লাহ বলেন, রোজার সওয়াব এভাবে দেয়া হবে না। রোজা একান্ত আমার জন্য এবং আমি নিজেই তার
সওয়াব দেব। অথবা রোজার বদলায় আমি নিজেই বান্দার হয়ে যাব। মহামহিম আল্লাহর নৈকট্য ও একান্ত সান্নিধ্য লাভের এ সুযোগ এনে দেয় রমজান সবার
জন্য। আল্লাহর সান্নিধ্যের এ সাধনায় কৃতকার্যতার জন্য পার হতে হয় কয়েকটি স্তর।
প্রথম স্তর সাধারণ রোজাদারের। মাহে রমজানে দিনের বেলা পানাহার ও যৌন সংসর্গ থেকে
বিরত থাকলেই বলা হবে লোকটি রোজা পালন করছেন। কিন্তু রোজা পালন করলেই হবে না,
আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার জন্য মানতে হবে অতিরিক্ত নিয়ম।
হাত, মুখ, কান, নাক বা পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে নিয়োজিত করতে হবে রোজা পালনে। প্রিয় নবী বলেছেন, যে ব্যক্তি রোজা রাখল,
অথচ মিথ্যা কাজ ও কথা ত্যাগ করল না, তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ কাজেই এ স্তরের রোজাদার হতে হলে সাধনার প্রয়োজন। নিজের পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে মন্দ
কাজ, কথা ও চিন্তা থেকে বিরত রাখতে হবে। শেষ স্তরে গিয়ে আল্লাহর
প্রিয় হওয়া বা সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াব নেয়ার জন্য প্রয়োজন মনের জমিনকে
সম্পূর্ণ আগাছামুক্ত করা। অন্য কথায়, আল্লাহ ছাড়া সবকিছু
থেকে খালি করা, তখনই আল্লাহর অবারিত রহমত ছেয়ে ফেলবে। সেই মন
রোজাদারের জীবন। আল্লাহপাক কিসে রাজি বা খুশি তা পালন আর আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন
এমন বিষয় বর্জন করতে হবে। আল্লাহর ফয়সালায় সদা সন্তষ্টচিত্ত থাকতে হবে। এর জন্য
সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, সবর বা ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা।
হাদিস শরিফে এরশাদ হয়েছে, যে রোজা রাখে সে যেন অশ্লীল কথা ও কাজ না করে, ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ গায়ে পড়ে তার সঙ্গে ঝগড়া বাধায় তাতেও সে
প্রতিক্রিয়া দেখাবে না, বরং বলবে, ‘আমি রোজাদার।’ যারা এই স্তর ও মানের রোজা রাখতে পারবে, আশা করা যায়, তারা তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত হতে পারবে, আল্লাহর প্রিয়জন হবে। আল্লাহর অলিদের খাতায় তাদের নাম লেখা হবে। এর জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আমাদের
মনের জাগৃতি, আল্লাহতে সমর্পিত হওয়ার শানিত চেতনা। তখনই
রমজানে কোরআন তেলাওয়াত, তারাবি, তাহাজ্জুদ ও ইবাদতের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়। রমজানে ঈমানের বসন্তে জেগে
ওঠুক আমাদের মন, জীবন, দেশ ও গোটা জাহান। জগতের প্রত্যেক ধর্মীয় মহাপুরুষ তাদের
অনুসারীদের মাঝে প্রবৃত্তিগুলোর অবদমন ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে উপবাসব্রত পালনের
প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি ও তা প্রচার করে গেছেন। হজরত মুসা (আ.) ৪০ দিবস রোজা
রেখেছিলেন। তাওরাতে রোজাকে ‘হাত্ব’ শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়েছে। এর অর্থ পাপ ধ্বংস করা। আর হজরত দাউদ (আ.) এর রোজা
বিশেষভাবে স্মরণ করা যায়, যা ‘সাওম দাউদী’ নামে পরিচিত। একদিন রোজা পালনের পর একদিন বিরতি
দিয়ে পরের দিন রোজা রাখার বিধান চালু ছিল। এতে শরীর দুর্বল হতো না। ফলে শত্রু
মোকাবিলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট শারীরিক সক্ষমতা বজায় থাকত। (শামি: ২য় খ-)। ‘যাবুর’ গ্রন্থে রোজাকে ‘ক্বোরবাত’ বলা হয়েছে। ক্বোরবাত অর্থ নৈকট্য লাভ করা।
আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হচ্ছে রোজা। হজরত ঈসা (আ.) মরুভূমিতে ৪০ দিবস রোজা রেখে তার শিষ্যদের রোজা পালনের উপদেশ
দিয়েছিলেন। ‘ইঞ্জিন’ শরিফে ‘ত্বাব’ শব্দটি রোজার পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে,
পবিত্র হওয়া অর্থে। রোমক, ব্যবিলনীয়, আসিরীয়, হিন্দু, জৈন, জোরস্ত্রীয়, বৌদ্ধ প্রভৃতি ধর্মে উপবাসব্রত পালনের প্রচলন ছিল। এখনও কতক ধর্মের অনুসারীরা উপবাসব্রত পালন করে আসছে। যদিও ধরন ও
প্রক্রিয়াগতভাবে তাদের উপবাস (সাওম) আমাদের থেকে কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। আত্ম
পরিশুদ্ধির উত্তম মাধ্যম হিসেবে উপবাস (সাওম) সব ধর্ম ও সংস্কৃতিতে স্বীকৃত।
প্রাচীন মিসরীয় ধর্মীয় আচার ছাড়াও গ্রিক ও পারসিক ধর্মেও সাওমের প্রচলন ছিল।
(এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা)। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি অবতীর্ণকৃত
ঐশীগ্রন্থ আল কোরআনে সাওম পালনের মাস রমজানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলাম
নির্দেশিত প্রার্থনার মাধ্যম হিসেবে সাওমের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি বা অতিশয় উদারতার
সুযোগ রাখা হয়নি। একনাগাড়ে ৪০ দিবস রোজা রাখা বা বছরে দু-একদিন পানাহার না করা,
আমিষ না খাওয়া, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য
পূরণে অথবা শোক প্রকাশের লক্ষ্যে উপবাসব্রত পালন অন্যান্য ধর্মে প্রচলন থাকলেও
ইসলাম সহজাত দ্বীন হিসেবে বান্দার ক্ষেত্রে উপযোগী ও সর্বজনীনভাবে সাওম পালন করার
বিধান রেখেছে। বান্দার সর্বোচ্চ কল্যাণ তথা ফায়দা রয়েছে সাওম পালনের মধ্য দিয়ে।
আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের রোজা তোমাদের জন্য কল্যাণকর।’ (সূরা বাকারা : ১৮৪)। রমজানের সিয়াম সাধনা মানুষের মধ্যে নৈতিক শৃঙ্খলাবোধ জাগিয়ে তোলে। এর মাধ্যমে
মানুষ নৈতিক শিক্ষার পাঠ গ্রহণ করে জীবনে দীনতম অবস্থা ও কঠিনতম সাধনার জন্য
প্রস্তুতির ‘সবক’ গ্রহণ করে; আত্মতৃপ্তির প্রলোভন জয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে। রমজানের
অন্তর্নিহিত প্রভাবে মানুষ পাপাচার, কুচিন্তা, প্রবৃত্তির অসৎ কার্যাদি থেকে আত্মাকে মুক্ত করে।
রোজার দ্বারা প্রবৃত্তির ওপর আমলের পরিপূর্ণ
নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্ষুধা ও পিপাসার কারণে মানুষের জৈবিক ও পাশবিক ইচ্ছা
হ্রাস পায়। এতে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়, অন্তর বিগলিত হয়
রাব্বুল আলামিনের প্রতি কৃতজ্ঞতায়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দৃঢ়বিশ্বাস ও এহতেসাবের সঙ্গে রমজানের রোজা রাখল তার পেছনের সব
গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (সহিহ বোখারি)। আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্য ছাড়াও রোজার সামাজিক
মূল্য রয়েছে। নামাজে যেমন ধনী-গরিব, আমির-ফকির এক কাতারে
দাঁড়িয়ে যায়, অনূরূপভাবে সবাই সিয়াম সাধনাকালে উভয় শ্রেণী
খাদ্য-পানীয় থেকে বিরত থেকে ক্ষুধার দংশন অনুভব করে। ফলে ধনী দরিদ্রের প্রতি
সহানুভূতিশীল হয়। আর রোজা পালনে মানুষের দৈহিক মূল্যও কম নয়।
আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রোজা রাখো, তাহলে সওয়াব ছাড়াও স্বাস্থ্য লাভ করবে।’
(তাবরানি)। রমজানে দিবাভাগে পানাহার থেকে বিরত থাকলে
স্বাস্থ্যের উৎকর্ষ সাধিত হয়। পাকস্থলী কিছুটা বিশ্রাম পায় বলে হজমি শক্তি বৃদ্ধি
পায়। ফলে শরীরের বলবীর্য ফিরে আসে। মোটকথা, আত্মিক উৎকর্ষতা, পরকালীন কল্যাণ লাভের এক বেহেশতি সওগাত বয়ে আনে পবিত্র রমজানুল মোবারক।