Latest News

প্রবাসীর লাশ হিমাঘারে আর কত দিন?

মহিবুল হাসান খান কয়েশ
যে মুহূর্তে লিখতে বসেছি, ঠিক সেই মুহূর্তে আমার বাঙালি কিছু বন্ধু বান্ধব বার্সেলোনা শহরে চাঁদা উঠাতে বের হয়েছেন।  চাঁদা শব্দটি ভদ্র ভাষায় লিখলাম। পাঠক, আমরা যখন কাউকে কোনো কারণে চাঁদা দেই বা দিতে হয় তার ঠিক পিছনেই কিছু কথা বলে ফেলি বা বলি। কি বলি তা আপনারা ভালো করেই জানেন। আমি শুধু এটুকু বলব যে, চাঁদা কখনো, কোনো অবস্থাতেই কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃতভাবে দেননা। তা আমার বাংলাদেশেই হোক; আর তা বহির্বিশ্বের যেখানেই হোক। হয় তা কোনো অপশক্তির কাছ থেকে নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে নয়তো হিতকর কোনো কল্যাণকামী কাজের জন্য। এখন বলা যায় কল্যাণকামী কাজের জন্য আমরা স্বত:স্ফুর্তভাবেই চাঁদা দিয়ে থাকি। কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন থাকে যে, সেই কল্যাণকামী কাজটি যখন শুধুমাত্র সবার চাঁদার উপরেই নির্ভরশীল হয়, নয়তো সেই কাজ থেমে থাকে- তাহলে কি সেটাকে আমরা স্বত:স্ফুর্তভাবে দেয়া চাঁদা বলতে পারি?
একটু চা যদি বাইরে খাই তাহলেও আশেপাশে কোনো বন্ধু বান্ধব আছেন কিনা তা জানার চেষ্টা করি। কারণ চা খেতে খেতে কিছু আলাপ আলোচনা করা যায়। একা থাকার সময় যদিও নাই, তারপরেও একটু সময় পেলে আড্ডায় মেতে উঠার চেষ্টা করি। কিন্তু আজ সেই বন্ধুদের সাথে যেতে মন চায়নি। কিছু লিখব তাও ভাবিনি, কিন্তু লিখছি। কিন্তু যা লিখছি তা কি আমার প্রিয় বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসে থাকা আমলারা সহজ ভাবে মেনে নেবেন? মেনে নেবেন কি তারা যারা সারা দিনমান জনকল্যাণে নিয়োজিত বলে দাবিদার রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দ? ফিঙে পাখি যখন গান গায় তখন কিছু কিছু দুষ্ট ছেলের দল সেই ফিঙে পাখিকে তাড়া করে বেড়ায়। বেচারা ফিঙে এ গাছ থেকে ও গাছে, এ ডাল থেকে ও ডালে পালিয়ে বেড়ায় ঠিকই; কিন্তু তার গান থেমে থাকেনা। দু:খের হোক, আর হোক সুখের- তার গান সে গেয়েই চলে। ঠিক তেমনি আমার কথা আমি বলেই যাব। যদিও কোনো সুখের বিষয় নিয়ে লিখতে চাইলেও আমি পারছিনা। কারণ এ জগতে সুখের বড়ই অভাব।
বার্সেলোনা শহরে গত সপ্তাহে অতি অমায়িক একজন পুরুষের জীবনাবসান হয়েছে। যিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্সেলোনায় বসবাস ও বিভিন্ন সামাজিক সংঘটনের সাথে শুধু জড়িয়েই ছিলেন, তা নায়; বরং সামনের কাতারে থেকে বাংলার কৃষ্টি কালচার তদুপরি বাংলাদেশকে তার নিজস্ব অবয়বে পরিচিত হতে করণীয় সব করতে কখনো কার্পন্য করেননি।
প্রবাসী ছাদিকুর রহমান এর লাশ এখনো বার্সেলোনার হিমাঘারে পড়ে আছে
সামান্য সময়ের জন্য হলেও আমি তার সান্নিধ্য পেয়েছি।  আজ তার অনুপস্থিতে তার  মহান কর্মের প্রতি মাথা নত করছি। পাঠক, যার কর্মের  প্রতি মাথা নত করছি; তিনি এখন লাশ। এখন হিমাগারে পড়ে আছেন। প্রথমে আমার যে বন্ধুদের চাঁদা তুলার কথা বললাম, তা আমার সেই শ্রদ্ধেয় মানুষটির নিথর দেহটা বাংলাদেশে তার পরিবার পরিজনের কাছে পাঠানোর জন্য। আর আমি যাইনি আলসেমিতে না; বরং লজ্জায়, অপমানে। আমি নীরবে বসে যে লজ্জার জালে ছটফট করছি, তার  তিল পরিমাণ লজ্জা কিভাবে আমি আমার দেশের আমলাদেরকে দেব, তা কি আমাকে কেউ বলে দেবেন?
দেশ ছেড়েছি মাত্র কিছুদিন। তার আগেতো দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানো সার ছিল। সেই ঘুরে বেড়ানোর মাঝে কত সঙ্গতি অসঙ্গতি চোখে পড়েছে; তা কখনো দেখেও দেখিনি। শুনেও শুনিনি। কিন্তু আজ সেই দেখা, সেই শুনা চোখে ভাসে, আর কানে বাজে। কি দেখিনি? কোনরকমে মামা খালুর মেহেরবানীর বদৌলতে একটা সরকারী চাকরি যোগাড় করে তার উপর ভর করে অল্প কিছুদিনের মধ্যে গাড়ি বাড়ি ব্যাঙ্ক ব্যালান্স কোনো কিছুরইতো কমতি থাকেনা। দিনের বেলায় কর্মস্থলের ঝুড়ি খালি আর রাতের বেলায় ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক নেতা নেত্রীর ছায়া কামনা- এই আমার সোনার বাংলার সোনার আমলাদের বড় পরিচয়। কিন্তু আমার মত লক্ষ লক্ষ আম জনতা চিৎকার করে গলার স্বর-নালী ফাটিয়ে ফেললেও তাদের কিচ্ছু আসে যায় না। তারা তাদের অবস্থানে অনড়। আর অনড় থাকাটাই স্বাভাবিক। কেননা আমরা যা বলব তা হবে চিরাচরিত আইনের বাইরে। আর তারাতো কড়ায় গন্ডায় আইন অনুসরণ করেই, যা করার করেন। ছোট মাথা নিয়ে বড় কথা বলব তা কি হয়? তাই মনে যা আসছে তাই বলছি।  বলার কারণটাও সঙ্গত। আমার বাংলাদেশী ভাই হিমঘরে পড়ে আছে বার্সেলোনায়, আর তার পরিজন সেই লাশ দেখতে, ধর্মীয় কায়দায় সমাহিত করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। হয়ত তারা আর এখন কাঁদতেও পারছেনা।  কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি কতটুকু অবশিষ্ট, তা এত দিন পর সহজেই অনুমেয়। একদিকে দেশে স্বজনের কান্না, অপেক্ষা আর অন্যদিকে অন্ধকার হিমঘরে লাশের অনিশ্চিত পড়ে থাকা!  আমরা যারা দেশের বাইরে পড়ে আছি, তারা কি এর কারণটা সম্পর্কে কিছুটা বিদ্রোহী হতে পারিনা? আমি কি বলতে পারিনা যে, দেশ থেকে বের হয়ে  যে মানুষটি দেশের কল্যাণে টাকা পাঠায় আর সেই পাঠানো টাকার রেমিটেন্স দিয়ে দেশ চলে, সেই মানুষটি মরে গেলে তার লাশটি প্রবাসের হিমঘরে কেন পড়ে থাকবে? আমরাতো শুনি বাংলাদেশের নেতা নেত্রীরা প্রবাসীদের দেশের সেরা সম্পদ বলে ঘোষণা করেন। সেই সেরা সম্পদ কি হিমঘরে ফেলে রাখার মত বস্তু? দেশের আমলারা যদি রাতারাতি দেশের খেয়ে, দেশের পড়ে, দেশের টাকায় পাহাড় তৈরী করতে পারে, আর তাদেরকে বহাল তবিয়তে রাখা হয়, তাহলে শরীরের ঘাম পায়ে ফেলে জন্মভূমির কল্যাণে যারা মহান ভুমিকা পালন করে চলেন, তাদের জীবদ্দশায় না হোক অন্তত অন্তিম কালে কিছু টাকা সরকারী কোষাগার থেকে খরচ করে বিদেহী শরীরটাকে আত্মীয় স্বজনের কাছে ফেরত পাঠাতে কেন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়না? আমি সেই উদাসীনতাকে ধিক্কার জানাই। তার সাথে তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যারা বিদেশ বিভুঁইয়ে কোনো বাঙালির জীবনাবসান ঘটলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ও অন্যকে উৎসাহিত করেন।  ফলে দেশে পড়ে থাকা মা বাবা ভাই বোন তাদের আপনজনকে শেষ দেখাটা দেখতে পান। কোনো ভালো কর্মের পর আমরা সেই কর্মটা যেন আবার করতে পারি।  আমি সরকারী কর্মকর্তাদের সম্পর্কে যা বলেছি তা জেনে শুনে বুঝেই বলেছি। আর এই অপরাধের জন্য কক্ষনো আমি অন্যায় করেছি বলে মার্জনা প্রার্থনা করবনা বরং দেশের সার্বিক অরাজকতা দূর করে একটি সুন্দর পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সকল প্রবাসীদের পক্ষ থেকে আহ্বান জানাচ্ছি। এমন আশা করব যেন আর কক্ষনো  কোনো প্রবাসীর লাশ টাকার বা সরকারী সহযোগিতার অভাবে একটি দিনের জন্য হিমঘরে পরে না থাকে।
বার্সেলোনা, স্পেন।

যোগাযোগ

Editor:Sahadul Suhed, News Editor:Loukman Hossain E-mail: news.spainbangla@gmail.com