Latest News

মা যদি মামা হয়, মামা হবে কি?

মহিবুল হাসান খান কয়েশ ছোটবেলায় সৈয়দ মুজতবা আলীর রসগোল্লা নামক একটা গল্প পড়েছিলাম। যদি বলি গল্পটা শতবার পড়েছি তাহলে ভুল হবে; কারণ আমি নিজে অনুমান করেও বলতে পারবনা যে কত শতবার সেই গল্প আমি পড়েছিলাম। রসগোল্লা গল্প ভেকুয়াম পেক্ড মিষ্টি নিয়ে। না, সেই মিষ্টির লোভে আমি সেটা পড়িনি; বরং মিষ্টি নিয়ে লেখক লিখতে গিয়ে পুরা গল্পে এমন মিষ্টির রস ছড়িয়ে রেখেছেন যে আমি ছোটখাটো পিপিলিকার মত হলেও মহা খাদকের আদলে প্রায় প্রতিদিন সেই গল্প নিয়ে বসতাম। আজ পর্যন্ত আমি সেই গল্পে মিশে থাকা মধু মনে মনে অস্সাদন করি। অবশ্য কিছুটা শিক্ষাও সেই মহান লেখকের লিখা পড়ে পেয়েছি যে, গল্পে মধু মাখা থাকলে সেই গল্প পাঠক চেটে চুটে না খেলেও অন্তত মুখে আঙ্গুল দিয়ে পেট খালি করেননা। লিখতে বসে ধার দেনা করে হলেও কিছুটা রস আমি আমার লিখায় মিশানোর চেষ্টা করে থাকি। কখনো কোনো বিষয়ে লিখব ঠিক করে আঙ্গুল প্রস্তুত করিনা বরং লিখার পরে আমি বুঝি কোন বা কি বিষয়ে লিখেছি। কিন্তু আজকের লিখাটা কি লিখব, তা বেশ কিছুদিন আগেই স্থির করেছিলাম এবং আমার অত্যন্ত প্রিয়, কলম সৈনিক সাহাদুল সুহেদ ভাইয়ের সাথে আলোচনাও করেছিলাম। বিধি বাম। লিখব বলে বাসায় এসে কলমের বদলে জ্বরের ঔষধ হাতে নিতে হলো। দিন পাঁচেক কিভাবে গেল তাও বলতে পারিনি। মনে মনে লিখা দেয়ার কথা থেকে সরে আসার কারণ সুহেদ ভাই হয়ত এই লিখা পড়েই অনুধাবন আর তৎসঙ্গে আমাকে মার্জনা করবেন। জ্বর যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই চলে গেল; কিন্তু সাথে আমার লিখার সেই রস বোধকে রসাতলে পাঠাতে কৃপণতা করেনি। আজ লিখতে বসে লিখা পাচ্ছি; কিন্তু এদিক ওদিক হাত বাড়িয়েও একটু রস জোগাড় করতে পারছিনা। তারপরেও লিখব। লিখবই। শুরুতেই ছোটবেলার পড়া গল্প নিয়ে পাঠকের সময় নষ্ট করেছি। অবশ্য ছোটবেলার কথা মনে হলে খুব বেশি মানুষ পাওয়া যায়না, যাদের মন খারাপ হয়। স্কুল ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে থাকা, পাড়ার ছেলেদের নিয়ে গাছের মগডাল থেকে পাকা ফলটি পেরে আনা, পাখির বাচ্চা ধরে খাঁচায় পুষা, সারা দুপুর মধ্য পুকুরে সাঁতরিয়ে বেড়ানো আরো কত কি! তবে সব থেকে মধুর স্মৃতি হয়তো সেটাই হবে যেটা মামার সাথে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশে একটি খুব বেশি প্রচলিত বচন বহুবার শুনেছি, তা হলো- মামা ভাগ্না যেখানে আপদ নাই সেখানে। আমরা যারা স্পেনের বার্সেলোনায় বসবাস করি তারা মামা বিহীনভাবে বসবাস করছি। কারনটা পরিষ্কার করা খুবই প্রয়োজন। তবুও লিখার স্থরে স্থরে পাঠক অবশ্যই খুঁজে পাবেন, কথা দিচ্ছি। বার্সেলোনায় আসার পরপরই এখানে বাঙালি কমিউনিটিতে, প্রত্যেক বাঙালির মধ্যে যে দেশপ্রেমের নিদর্শন ছায়া দেখতে পেয়েছি, তা আমাকে যারপরনাই আনন্দিত করেছে। দেশে থাকতে প্রবাসীদের প্রতি যে ভুল ধারণা ছিল, তাও কেটে যেতে লাগলো। একটু সময় পেলেই দু’জন, তিনজন একত্রিত হয়ে গল্প আর সেই গল্প দেশ নিয়ে, দেশের আর্থ সামাজিক বা রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে। যা নিয়েই হোক, গল্প জমে দেশ ঘিরে- সেটাই মূল কথা। সেই আড্ডা থেকেও শিক্ষা নেই আমরা। এত কাজ, এত ব্যস্ততা; কিন্তু সব ছাড়িয়ে সব প্রবাসীরা যেন বাংলা মা কে নিয়ে ব্যস্ত। কত খুশির কথা। সময় যত যায়, ততই বার্সেলোনার বাঙালিদের মধ্যে বাঙালিয়ানার প্রায় শতভাগ চোখে পড়তে লাগলো। কিন্তু যা দেখে মন খারাপ হলো, তা-ই আজকের লিখার মূল বিষয় বস্তু। সারা বছর কাজের ব্যস্ততায় পারিবারিক আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ ছাড়া ঘটা করে কোনো উৎসব আয়োজন একমাত্র বৈশাখী মেলা ছাড়া প্রায় হয়না বললেই চলে। বৈশাখী উৎসবে সকল ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রাণবন্ত উপস্থিতি ও আনন্দ উল্লাস দেখে সর্বশেষ বৈশাখী মেলার সঞ্চালক হিসাবে আমি মঞ্চ থেকে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, আজ এই জায়গাটাকে আমার প্রিয় জন্মভূমি ছোট্ট একটা বাংলাদেশ মনে হচ্ছে। গলায় গামছা, গায়ে ফতুয়া, পাঞ্জাবি, পরনে কারো কারো লুঙ্গি, পায়ে চটি জোড়া, মহিয়ার মত পারের শাড়ি। আহারে কি অপূর্ব দৃশ্য! আশপাশের দালানকোঠা না দেখলে বুঝার উপায় নেই যে এটা বার্সেলোনা, বাংলাদেশ না। শিল্পীরা মঞ্চে আসেন। বাদ্যের তালে তালে নাচ আর সেই নাচের মাধ্যমে বাংলার চির নৈসর্গিক রূপ ফুটিয়ে তুলেন। কন্ঠ শিল্পীরা মধু মিশ্রিত কন্ঠে বাংলার রূপ বৈচিত্র বর্ণনা করে চলেন। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধদের চোখে মুখে সেদিন যে আনন্দের বন্যা দেখতে পাই, তা বর্ণনা করা সত্যি কঠিন। ভালো করে লক্ষ্য করলে কারো কারো চোখ দেশের কল্পনায় অশ্র“তে ঢেকে যায়। আবার পরক্ষণেই তা সবার আড়ালে মুছে আনন্দে সামিল হন। পিঠা পুলির সমাহারে ও তার গন্ধে আশপাশ ঢেকে যায়। আনন্দ আয়োজন শেষ হবার পরের আয়োজন কবে তা জানতে ইচ্ছে করে। বার্সেলোনায় প্রতিটা বাবা মা তাদের সন্তানকে বাঙালি কৃষ্টি সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দিতে, শিক্ষা দিতে, বাঙালি ধাঁচে বড় হতে এমন কোনো চেষ্টা নেই, যা করেননা। আমি অবাক চোখে তা দেখেছি। কোনো ছেলে মেয়ে যারা বার্সেলোনায় জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠছে, তারা বাংলায় একটি গান, একটি কবিতা অথবা বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুটা বলতে পারলে তাদের বাবা মায়ের চোখে আনন্দের বন্যা বয়ে চলে। এখানে আন্তর্জাতিক বাংলা স্কুল নামে একটি স্কুল আছে। আর এটিতে বাংলা অক্ষর অ আ থেকে শুরু করা এবং যতদূর সম্ভব বাংলা শিক্ষা দেয়া হয়। কি চমৎকার চিন্তা চেতনা। হোচট খেলাম এইত সেদিন। যেদিন হঠাৎ শুনলাম এক বাঙালি বাচ্চা তার মাকে মামা বলে জড়িয়ে ধরল। আরে কি সর্বনাশ! বাঙালি ছেলে ’মা’ কে বলল ’মামা’? তাহলে কি সদা সচেষ্ট বাবা মায়ের চেষ্টা বৃথা ? কেননা প্রতিটি বাঙালি বাচ্চা প্রথম তার ’মা’ কে মা বলে কথা শুরু করে। আর এখানে? যদি এখানে ’মা’ কে মামা, ’বাবা’ কে পাপা ডাকা শিখানো হয়, তাহলে আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি একেবারেই শুরুতে হুচট খায়না? মূল শিক্ষা থেকে সরে এসে আমরা কি আমাদের কাংখিত সেই বাঙালি শিক্ষা নতুন প্রজন্মকে দিতে পারব? আমার এই লিখার যদি কেউ বিরোধিতা করেন, তাহলে আমি কারো সাথে যুক্তি তুলে ধরব সেই সক্ষমতা আমার নেই। তবে আপনার বাচ্চাকে তার মাকে মামা ডাক শেখানোর আগে বাঙালি কৃষ্টিতে যাকে মামা ডাকা হয় অর্থাৎ মায়ের ভাইয়ের জন্য নতুন কোনো একটা ডাক আবিস্কার করুন। নতুবা মা নামের মামা পেয়ে মামা কে হারিয়ে সেসব ভাগ্না ভাগ্নিগুলা মামাহীন হবে! আর হতভাগ্য বাঙালি মামারা ভাগ্না ভাগ্নিহীন হবেন! নতুবা মাকে ডাকলে আসবেন মামা, আর মামাকে ডাকলে মা। তাহলে ফলাফল কি হলো? শিরোনাম দেখুন দয়া করে। ১৭ জুন ২০১৪ ইং বার্সেলোনা, স্পেন।

যোগাযোগ

Editor:Sahadul Suhed, News Editor:Loukman Hossain E-mail: news.spainbangla@gmail.com