এসবিএন ডেস্ক : ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকায় ৪০ ঘণ্টার সফর শেষ করে গত ২৭ জুন শুক্রবার দিল্লি ফিরেছেন। তিনি ঢাকা ছাড়লেও তার সফর নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ছাড়েননি এদেশীয়রা। বিমানে উড়াল দেওয়ার পূর্বেই নানা হিসাব-নিকাশ শুরু হয় সুষমাকে নিয়ে। প্রশ্ন ওঠেছে, কে কি পেলো? না-কি কেউ কিছু হারালো? প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাতে শুরু করেছে ঢাকার কর্তা ব্যক্তিরা। বাংলাদেশে যারা ক্ষমতায় রয়েছেন আর যারা ক্ষমতার বাইরে রয়েছেন তাদের সবাই সুষমা ঘোরের মধ্যেই রয়েছেন।
সুষমার ঢাকা সফরে দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাধারণ আলোচনা হলেও মূল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ক্ষমতায় টিকে থাকা আর ক্ষমতা ফিরে পাওয়া নিয়ে। সরাসরি কেউ কিছু না বলে কৌশলী হওয়ার চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি। প্রত্যেকে যার যার অবস্থানে থেকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেছে। কিন্তু এর সুফল কার ঘরে আসবে- এটাই এখন আলোচনার শীর্ষে চলে এসেছে।
সফর নিয়ে ধূম্রজাল
শুরুতেই সুষমার সফর নিয়ে নানা ধরনের ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। ২৫ জুন ভারতের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসবেন- এ খবর যখন মিডিয়ায় আসতে শুরু করে প্রথমে এমন কথা বুঝানো হয়েছিল যে, সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর একটি আমন্ত্রণপত্র দেওয়ার জন্যই বাংলাদেশে আসছেন। সফরকালে সুষমা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পক্ষ থেকে একটি আমন্ত্রণপত্র দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু শুধু এ পত্র দেওয়ার জন্যই যে তিনি আসেননি তা সফরকালীন সার্বিক ঘটনাবলী থেকেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য আমন্ত্রণপত্র দেওয়াটাই সুষমার মূল লক্ষ্য থাকতো তাহলে এটা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের জন্য খুবই আশার কথা ছিল। তবে এ সফর এমন কোনো বিশেষ আশা’র বাণী শোনাতে পারেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে। সুষমার সফরের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পর তিস্তাসহ বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে আলোচনা, এমনকি এসব বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে এমন বলেও প্রচারণা ছিল। অথচ চুক্তিতো দূরের কথা বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিভিন্ন অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে উল্লেখ করার মতো কোনো আলোচনাই হয়নি। অবশ্য বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো যা-ই বলুক, ভারতের পররাষ্ট্র দফতর থেকে কিন্তু ঠিকই বলা হয়েছিল, এটি একটি শুভেচ্ছা সফর।
সফরকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী’র সঙ্গে বৈঠক নির্ধারিত ছিলো। শুরুতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমগুলোয় এমন ধারণা দেওয়া হয়েছিলো, সুষমা এই তিনজন ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে বৈঠক করবেন না। শুধু তাই নয়, স্পষ্ট করে এমন খবরও প্রচারিত হয়েছিলো যে, বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট (তৎকালীন ১৯ দলীয় জোট) নেতা বেগম খালেদা জিয়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাত পাচ্ছেন না। সুষমার সফরকেন্দ্রিক এসবই ছিল আওয়ামী লীগের জন্য পজেটিভ খবর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী দেখা গেল? সুষমা বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে শুধু বৈঠকই করেননি। ১২ মিনিটের জন্য একান্ত বৈঠকেও মিলিত হয়েছিলেন উভয় নেতা। যা রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় ধরনের এক কৌতূহলের সৃষ্টি করে। খালেদা-সুষমা বৈঠকই আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দাওয়াতপত্র দেওয়ার জন্য সুষমা আসছেন এমন প্রচারণা চালানো হলেও সুষমার সফর শেষ হওয়ার পর বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি কোনো নিছক দাওয়াতপত্র প্রদানের সফর নয়। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে ১২ মিনিট
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে একান্তে ১২ মিনিট কথা বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। ওই সময় একান্তে কী আলাপ-আলোচনা হয়েছিল তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বত্র কৌতূহলের অন্ত নেই। সকলের সামনে একই প্রশ্ন, কী এমন আলাপ হয়েছে দুই দেশের দুই নেত্রীর মধ্যে যা নিয়ে এতো গোপনীয়তা রক্ষা করতে হলো? ওই ১২ মিনিটে কী বাংলাদেশ-ভারতের স্বার্থ, না কি বিজেপি-বিএনপির স্বার্থ নিয়ে আলোচনা হয়েছে? ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা শেষ করে পরে ওই একান্ত বৈঠকে মিলিত হন খালেদা জিয়া। এটি হয়েছিল হোটেল সোনারগাঁওয়ের অষ্টম তলায় ৮২৪ নম্বর ‘বেঙ্গলী’ প্রেসিডেন্ট স্যুটে। তখন থেকেই সবার দৃষ্টি ছিল ওই কক্ষের দিকে। সুষমার সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপির সিনিয়র কয়েকজন নেতার সঙ্গে খালেদা জিয়া আরেকটি বৈঠক করেন। এ বৈঠকে সুষমার সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার বৈঠকের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। সুষমা-খালেদা একান্তে কী আলাপ হয়েছে এরও একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন। খালেদার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন বিএনপির নেতা গণমাধ্যমকে বলেছেন, একান্ত বৈঠকে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। একই সঙ্গে জনগণের প্রত্যাশার কথাও জানিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। তার দল ক্ষমতায় আসলে ভারতের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক রাখবে সে বিষয়েও কথা বলেছেন বিএনপি নেত্রী। একান্ত বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন, তার সরকার বাংলাদেশের বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক হবে বাংলাদেশের জনগণের।
বস্তুত, এমন ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা, যদিও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কারণ, এ কথাটি আলোচনার জন্য একান্ত বৈঠকের প্রয়োজন হয় না। প্রকৃত অর্থে সবাই মনে করছেন, উভয়ের মধ্যে সমঝোতামূলক অতি গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু আলোচনা হয়েছে যা কৌশলগত কারণে এ মুহূর্তে বাইরে প্রকাশ করা হচ্ছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সুষমার একান্ত বৈঠকে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা কৌশলগত কারণে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি। ওই বৈঠকের মাধ্যমে বিএনপির সঙ্গে বিজেপির একটি সুসম্পর্ক তৈরির ইঙ্গিত রয়েছে। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, খালেদা-সুষমা বৈঠকে দু’দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন অন্য কথা। তাদের মতে, খালেদা-সুষমা বৈঠকের মুখ্য ইস্যু ছিল, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। আবার কেউ কেউ বলছেন, ওই ১২ মিনিটের বৈঠকের জন্যই ৩ দিনের ঢাকা সফরে এসেছেন সুষমা স্বরাজ। যা একটি কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে।
সুষমার সঙ্গে খালেদা জিয়ার অতীত সম্পর্ক
২০১২ সালের ২৮ অক্টোবর ভারত সফরে গিয়েছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ওই সময় তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের বিরোধী দলীয় নেত্রী। সাত দিনের সরকারি সফরে ভারতে গেলেও বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ওই সময় অনির্ধারিত এবং অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ভারতীয় লোকসভার তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা ও বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজের। দিল্লির ৮ নম্বর সবদরজং সড়কে দেশটির বিরোধীদলীয় নেতার সরকারি বাসভবনে সফরের প্রথমদিন অর্থাৎ ২৮ অক্টোবর বিকাল সাড়ে ৪টায় তারা বৈঠকে মিলিত হন। ওই সফরের সময় দুই দেশের দুই বিরোধী দলের নেত্রীর মধ্যে এক আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারা বেশ কিছু সময় একান্ত পারিবারিক আড্ডায়ও মিলিত হন। বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতার জন্য ভারতের বিরোধী দলের নেতার বাড়িতে বিশেষ রান্নার ব্যবস্থা হয়। সুষমা স্বরাজ তখন খালেদা জিয়াকে আন্তরিকতার সঙ্গে খাদ্য গ্রহণের অনুরোধ করে বলেছিলেন, তার মেয়ে নিজ হাতে নাকি খালেদা জিয়ার জন্য রান্না করেছেন। এ সময় বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সুষমা তার মেয়েকে পরিচয়ও করিয়ে দেন। ফলে দলীয় সম্পর্কের বাইরেও একটি পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ওই সময় দুই বিরোধী নেতা দুই দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একান্ত আলাপ-আলোচনা করেন। আর এবার গত ২৫ জুন বাংলাদেশ সফরে এসে সুষমা আবারো বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে একান্ত আলাপে মিলিত হলেন। যা নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই।
বিশেষ কোনো দলের পক্ষে থাকবে না ভারত
গত ২৬ জুন ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক মুখপাত্র সৈয়দ আকবর উদ্দিন ঢাকায় এক প্রেস ব্রিফিং করেন। এতে তিনি বাংলাদেশ-ভারতের ভবিষ্যত সম্পর্ক নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেন। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না তার দেশ। বিশেষ কোনো দলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনও করবেন না তারা। বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার আলোকেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হবে।
আগামী দিনে বাংলাদেশের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক হবে, এমন প্রশ্নে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও সাংবাদিকদের একই জবাব দেন। তিনি বলেন, ভারতের নতুন সরকার সার্কের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। ভারত সরকার নির্দিষ্ট কোন দল নয়, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে চায়। বাংলাদেশে শক্তিশালী গণতন্ত্র দেখতে চায় ভারত। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের নতুন সরকারের এই দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যেসব নীতিনির্ধারণী বক্তব্য দিয়েছেন তাতে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেলো, কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশের একটি বিশেষ দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা ও রাখার যে নীতি গ্রহণ করেছিলো তা অনুসরণ করবে না বিজেপি সরকার। তারা বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে সম্পর্ক বজায় রাখবে। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল ভারতের কাছ থেকে অতীতের মতো অনৈতিক কোনো সুবিধা পাবে না। আর এতে বাংলাদেশে একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সহজ হবে।
সুষমার সফরে রাজনৈতিক প্রভাব
সুষমা স্বরাজের সফরকে যে যেভাবেই মূল্যায়ন করুক না কেন এ সফর যে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ প্রভাব ফেলবে এতে কারো দ্বিমত নেই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হবে না বলে সুষমা স্বরাজ যে মন্তব্য করেছেন এদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পট-পরিবর্তনের জন্য তা-ই যথেষ্ট। তার ওই বক্তব্যটিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। এটি এদেশের রাজনীতিতে বিশেষ প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করছেন তারা। এরা বলছেন, ভারতের এই অবস্থানগত পরিবর্তন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কারণ, এটা সবাই বোঝেন এবং বিশ্বাস করেন, ভারতের কংগ্রেস সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পক্ষে গত ৫ জানুয়ারি একতরফা একটি নির্বাচন করিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। কংগ্রেস সরকারের সরাসরি একগুঁয়ে সমর্থন না থাকলে ভোটারবিহীন ওই নির্বাচন করিয়ে নেওয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে হয়তো সম্ভব হতো না। ভারতের বর্তমান সরকার যদি বাংলাদেশের বিশেষ কোনো দলকে সমর্থন না দেয় তাহলে এদেশের জনগণ অচিরেই তাদের পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, এই সফরে বিশেষ একটি বার্তা নিশ্চিত করেছেন সুষমা স্বরাজ। তাহলো, বাংলাদেশের একক কোন দলের সঙ্গে নয়, বরং বাংলাদেশের দুই বড় দলের সঙ্গেই সমান সম্পর্ক রাখতে চায় ভারত। তিনি বলেন, এদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বার্তা দিয়েছে ভারত- যা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, সুষমা স্বরাজের এই সফরে পরিষ্কার হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে তারা যথেষ্ট সচেতন।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সুষমার সফরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। তাহলো বাংলাদেশের কোন নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না তার সরকার। যেমনটি কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল।
সেখান থেকে সরে গিয়ে বিজেপি সরকার বলতে চায়, সম্পর্ক হবে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে। তিনি বলেন, সেমিনারে দেয়া সুষমার বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। সেই বক্তব্যে সুষমা বলেছেন, গণতন্ত্রের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সহনশীলতার সংস্কৃতি, অংশগ্রহণ ও ভিন্নমতের বিকাশ প্রয়োজন। অনুরোধ পেলে এ ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা ও অনুসৃত আদর্শ সানন্দে বিনিময় করবো। এখন দেখা দরকার যে, এই বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে কোনো পরিবর্তন আসে কিনা। তিনি বলেন, আমি আশাবাদী, এক ধরনের সংলাপ হয়তো শুরু হতে পারে। আওয়ামী লীগের এখন উচিত হবে, যত দ্রুত সম্ভব আলোচনা শুরু করে দেয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম. শাহীদুজ্জামান সুষমার সফর প্রসঙ্গে বলেন, ভারত সব সময় তাদের নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। সুষমার সফরে সীমান্ত চুক্তি ও তিস্তা চুক্তি সম্পর্কে ইতিবাচক কোন আশ্বাস পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য রাজ্য সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ। কারণ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এটি কেন্দ্রীয় সরকারের বাস্তবায়নের কথা। কংগ্রেস সরকারের চুক্তিতে স্বাক্ষর করার সময় এটি চিন্তা করা উচিত ছিল।
আওয়ামী লীগের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার?
ঢাকায় ৪০ ঘণ্টার সফরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ দুই দেশের সাধারণ মানুষের জন্য কী মেসেজ দিয়ে গেছেন এমন প্রশ্ন এখন সবার মুখে। তার পুরো সফর নিয়েই তীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখেছেন সচেতন মহল। সবার মধ্যে কৌতূহল জেগেছে, কী বার্তা নিয়েছেন বা দিয়েছেন ভারত সরকারের প্রভাবশালী এ মন্ত্রী। রাজনৈতিক দলগুলো কে কি পেলো হিসাব কষা হচ্ছে। বিশেষ করে সরকার ও বিরোধী দলের বাইরে থাকা বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোন্ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে সুষমার, এটিই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
ভারতে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য দাওয়াতের চিঠি নিয়ে আসছেন, এটা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য ছিলো নিঃসন্দেহেই সুখকর সংবাদ। তাই শুরু থেকেই সরকার নানাভাবে এটিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচারের চেষ্টা চালিয়ে আসছিলো। পুরো পরিবেশটা তাদের পক্ষে রাখতে চাইছিলো। যেহেতু ভারতে ক্ষমতার পট-পরিবর্তনের পর এমন একটা কথা উঠে আসছিলো যে, কংগ্রেসের পরিবর্তে বিজেপি ক্ষমতায় আসাটা আওয়ামী লীগের জন্য সুখকর হবে না। যেহেতু কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগের সম্পর্ক বন্ধুত্বের এবং পারিবারিক, তাই বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক মধুর হতে পারে না। ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’ এই ফর্র্মুলা অনুযায়ী বিএনপির সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক ভালো হবে- এমন কথাই প্রচারিত হচ্ছিলো নানাভাবে। শুধু তাই নয়, এ ফর্মুলার বাইরে এমন কথাও প্রচারিত হচ্ছিলো যে, বিজেপি’র সঙ্গে বিএনপি’র সম্পর্ক পুরনো এবং বেশ ঘনিষ্ঠ। বিশেষ করে বিজেপি নেতা ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তারেক রহমানের সম্পর্ক বেশ আগের।
আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহল এমন কথাকে স্রেফ প্রচারণা বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইছিলো। কারণ এ কথাগুলো যদি মানুষ সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করতে শুরু করে তাহলে তা সরকারের জন্য কুঠারাঘাত হিসেবে দেখা দেবে। প্রশাসনের ওপর সরকার কর্তৃত্ব হারাবে। তাতে সরকারের পক্ষে আর বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব হবে না। এটা সবাই বোঝেন, এ সরকার টিকে আছে শুধুমাত্র প্রশাসনের ওপর ভর করেই।
তাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এমন কথা ব্যাপকভাবে বলার চেষ্টা করছিলো, ভারতে সরকার পরিবর্তন হলেও নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না। বরং বিজেপি সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক কংগ্রেস সরকারের চেয়েও গাঢ়ো হবে। ভারত তাদের স্বার্থেই আওয়ামী লীগকে জোর করে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার নীতি অনুসরণ করবে।
কিন্তু, আওয়ামী লীগ সুষমার সফরকে যেভাবে কাজে লাগিয়ে সংকট উৎরে উঠতে চেয়েছিলো সেটা সম্ভব হয়নি। সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। শুধু তাই নয়, উল্টো এখন আওয়ামী লীগের পায়ের তলার মাটিতেও টান পড়েছে বলা যায়।
আওয়ামী লীগ সরকার চেয়েছিলো, বেগম খালেদা জিয়া যাতে সুষমার সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো সুযোগ না পান। সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রাণান্তকর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিলো। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। সুষমা শুধু বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে একান্ত বৈঠকই করেননি ১২ মিনিটের ‘ক্লোজ ডোর’ বৈঠক করেছেন।
এদিকে মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার রায়কেও টেস্ট কেস হিসেবে নিয়েছিলো সরকার। সুষমার সফরকালে নিজামীর রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে জামায়াতকে উস্কে দিয়ে দেশে একটা কৃত্রিম অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চেয়েছিলো সরকার। যাতে ভারত জামায়াত-বিএনপির ওপর বিরক্ত হয়। কিন্তু, সরকারের সেই উদ্দেশ্যও সফল হয়নি। এটি নিয়ে সরকারকেই উল্টো বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। যতোটা জানা গেছে, নিজামীর রায় নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষাপটে ভারত থেকে সরকারের ওপরই বিরক্তি প্রকাশ করা হয়। যেহেতু এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে তাই সুষমার সফর পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলে ভারত সরকার। ফলে আওয়ামী লীগ সরকার তড়িঘড়ি করে অসুস্থতার ইস্যু দাঁড় করিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নিজামীর রায় স্থগিতের পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।
সুষমার সফর সরকারের জন্য সবচে’ বড় আঘাত হিসেবে দেখা দিয়েছে তাদের দেশের অবস্থান পরিবর্তনের ঘোষণা। ২৬ জুন ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক মুখপাত্র সৈয়দ আকবর উদ্দিন প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেন, এবার সম্পর্ক হবে “(বাংলাদেশ-ভারত) কান্ট্রি টু কান্ট্রি” সম্পর্ক। বিশেষ কোনো দলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক হবে না।
তিনি আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, তার দেশ ক্ষুদ্র দলীয় রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দুই দেশের সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে না। সম্পর্ক হবে “জনগণ টু জনগণ”। বাংলাদেশের জনগণ যে ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করবে ভারত সে ধরনের সরকারের সঙ্গেই কাজ করতে বেশি পছন্দ করে। কংগ্রেসের শাসন আমলে বাংলাদেশের সঙ্গে দলীয় ভিত্তিতে সম্পর্ক চালিয়ে আসছিল। মোদির সরকার কী তা-ই করবে? এমন প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দেন আকবর উদ্দিন। তিনি বলেন, ভারত কখনও দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় না।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরো বলেন, সম্পর্কের বিষয়টি ‘ফ্রেশ গ্রাউন্ড’-এ দেখতে চায় তার সরকার। এটি অবশ্যই দলীয় পর্যায়ে নয়, এটি হবে অবশ্যই জনগণের পর্যায়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ মুখপাত্রের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কংগ্রেস যেভাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করেছে তা থেকে সরে এসেছে নতুন সরকার। বলা যায়, আওয়ামী লীগের ওপর থেকে সেই একগুঁয়ে সমর্থন প্রত্যাহার করেছে ভারত। এটাই বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য একটি বড় ঘটনা।
মোদি সরকারের কাছে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত গত ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের খবর রয়েছে। আর সে কারণেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সফরকালে অনেক বিষয়ই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সুষমার এ সফর আওয়ামী লীগ তার সরকারের জন্য ইতিবাচক বলে উল্লেখ করলেও বার্তা অনেকটা ভিন্ন বলে উল্লেখ করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সুষমার এ সফরে স্পষ্ট হয়েছে ভারতের নতুন সরকার বিশেষ কোনো দলের প্রতি অনুগ্রহ দেখাবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক হবে “স্রেফ কান্ট্রি টু কান্ট্রি”। বাংলাদেশের জনগণ যে ধরনের সরকার চায় তার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক রাখবে ভারত। বিশ্লেষকরা বলছেন, কংগ্রেস সরকারের একান্ত ইচ্ছার কারণেই গোটা বিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পক্ষে একটি একতরফা নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছিল। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং কীভাবে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ ও আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছেন সেটা সবাই দেখেছে। কিন্তু ভারতের বর্তমান সরকার যদি বিশেষ কোনো দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে তৎপরতা না চালায় তাহলে বাংলাদেশে দ্রুতই একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সহজ হবে। সুষমা স্বরাজ একথা বলে গেছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করবে জনগণ। এতে তারা হস্তক্ষেপ করবে না। আর ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করুক বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও সেটাই চায়।
সুষমার ঢাকা সফরে দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাধারণ আলোচনা হলেও মূল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ক্ষমতায় টিকে থাকা আর ক্ষমতা ফিরে পাওয়া নিয়ে। সরাসরি কেউ কিছু না বলে কৌশলী হওয়ার চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি। প্রত্যেকে যার যার অবস্থানে থেকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেছে। কিন্তু এর সুফল কার ঘরে আসবে- এটাই এখন আলোচনার শীর্ষে চলে এসেছে।
সফর নিয়ে ধূম্রজাল
শুরুতেই সুষমার সফর নিয়ে নানা ধরনের ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। ২৫ জুন ভারতের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসবেন- এ খবর যখন মিডিয়ায় আসতে শুরু করে প্রথমে এমন কথা বুঝানো হয়েছিল যে, সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর একটি আমন্ত্রণপত্র দেওয়ার জন্যই বাংলাদেশে আসছেন। সফরকালে সুষমা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পক্ষ থেকে একটি আমন্ত্রণপত্র দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু শুধু এ পত্র দেওয়ার জন্যই যে তিনি আসেননি তা সফরকালীন সার্বিক ঘটনাবলী থেকেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য আমন্ত্রণপত্র দেওয়াটাই সুষমার মূল লক্ষ্য থাকতো তাহলে এটা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের জন্য খুবই আশার কথা ছিল। তবে এ সফর এমন কোনো বিশেষ আশা’র বাণী শোনাতে পারেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে। সুষমার সফরের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পর তিস্তাসহ বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে আলোচনা, এমনকি এসব বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে এমন বলেও প্রচারণা ছিল। অথচ চুক্তিতো দূরের কথা বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিভিন্ন অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে উল্লেখ করার মতো কোনো আলোচনাই হয়নি। অবশ্য বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো যা-ই বলুক, ভারতের পররাষ্ট্র দফতর থেকে কিন্তু ঠিকই বলা হয়েছিল, এটি একটি শুভেচ্ছা সফর।
সফরকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী’র সঙ্গে বৈঠক নির্ধারিত ছিলো। শুরুতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমগুলোয় এমন ধারণা দেওয়া হয়েছিলো, সুষমা এই তিনজন ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে বৈঠক করবেন না। শুধু তাই নয়, স্পষ্ট করে এমন খবরও প্রচারিত হয়েছিলো যে, বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট (তৎকালীন ১৯ দলীয় জোট) নেতা বেগম খালেদা জিয়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাত পাচ্ছেন না। সুষমার সফরকেন্দ্রিক এসবই ছিল আওয়ামী লীগের জন্য পজেটিভ খবর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী দেখা গেল? সুষমা বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে শুধু বৈঠকই করেননি। ১২ মিনিটের জন্য একান্ত বৈঠকেও মিলিত হয়েছিলেন উভয় নেতা। যা রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় ধরনের এক কৌতূহলের সৃষ্টি করে। খালেদা-সুষমা বৈঠকই আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দাওয়াতপত্র দেওয়ার জন্য সুষমা আসছেন এমন প্রচারণা চালানো হলেও সুষমার সফর শেষ হওয়ার পর বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি কোনো নিছক দাওয়াতপত্র প্রদানের সফর নয়। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে ১২ মিনিট
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে একান্তে ১২ মিনিট কথা বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। ওই সময় একান্তে কী আলাপ-আলোচনা হয়েছিল তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বত্র কৌতূহলের অন্ত নেই। সকলের সামনে একই প্রশ্ন, কী এমন আলাপ হয়েছে দুই দেশের দুই নেত্রীর মধ্যে যা নিয়ে এতো গোপনীয়তা রক্ষা করতে হলো? ওই ১২ মিনিটে কী বাংলাদেশ-ভারতের স্বার্থ, না কি বিজেপি-বিএনপির স্বার্থ নিয়ে আলোচনা হয়েছে? ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা শেষ করে পরে ওই একান্ত বৈঠকে মিলিত হন খালেদা জিয়া। এটি হয়েছিল হোটেল সোনারগাঁওয়ের অষ্টম তলায় ৮২৪ নম্বর ‘বেঙ্গলী’ প্রেসিডেন্ট স্যুটে। তখন থেকেই সবার দৃষ্টি ছিল ওই কক্ষের দিকে। সুষমার সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপির সিনিয়র কয়েকজন নেতার সঙ্গে খালেদা জিয়া আরেকটি বৈঠক করেন। এ বৈঠকে সুষমার সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার বৈঠকের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। সুষমা-খালেদা একান্তে কী আলাপ হয়েছে এরও একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন। খালেদার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন বিএনপির নেতা গণমাধ্যমকে বলেছেন, একান্ত বৈঠকে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। একই সঙ্গে জনগণের প্রত্যাশার কথাও জানিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। তার দল ক্ষমতায় আসলে ভারতের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক রাখবে সে বিষয়েও কথা বলেছেন বিএনপি নেত্রী। একান্ত বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন, তার সরকার বাংলাদেশের বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক হবে বাংলাদেশের জনগণের।
বস্তুত, এমন ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা, যদিও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কারণ, এ কথাটি আলোচনার জন্য একান্ত বৈঠকের প্রয়োজন হয় না। প্রকৃত অর্থে সবাই মনে করছেন, উভয়ের মধ্যে সমঝোতামূলক অতি গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু আলোচনা হয়েছে যা কৌশলগত কারণে এ মুহূর্তে বাইরে প্রকাশ করা হচ্ছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সুষমার একান্ত বৈঠকে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা কৌশলগত কারণে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি। ওই বৈঠকের মাধ্যমে বিএনপির সঙ্গে বিজেপির একটি সুসম্পর্ক তৈরির ইঙ্গিত রয়েছে। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, খালেদা-সুষমা বৈঠকে দু’দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন অন্য কথা। তাদের মতে, খালেদা-সুষমা বৈঠকের মুখ্য ইস্যু ছিল, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। আবার কেউ কেউ বলছেন, ওই ১২ মিনিটের বৈঠকের জন্যই ৩ দিনের ঢাকা সফরে এসেছেন সুষমা স্বরাজ। যা একটি কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে।
সুষমার সঙ্গে খালেদা জিয়ার অতীত সম্পর্ক
২০১২ সালের ২৮ অক্টোবর ভারত সফরে গিয়েছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ওই সময় তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের বিরোধী দলীয় নেত্রী। সাত দিনের সরকারি সফরে ভারতে গেলেও বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ওই সময় অনির্ধারিত এবং অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ভারতীয় লোকসভার তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা ও বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজের। দিল্লির ৮ নম্বর সবদরজং সড়কে দেশটির বিরোধীদলীয় নেতার সরকারি বাসভবনে সফরের প্রথমদিন অর্থাৎ ২৮ অক্টোবর বিকাল সাড়ে ৪টায় তারা বৈঠকে মিলিত হন। ওই সফরের সময় দুই দেশের দুই বিরোধী দলের নেত্রীর মধ্যে এক আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারা বেশ কিছু সময় একান্ত পারিবারিক আড্ডায়ও মিলিত হন। বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতার জন্য ভারতের বিরোধী দলের নেতার বাড়িতে বিশেষ রান্নার ব্যবস্থা হয়। সুষমা স্বরাজ তখন খালেদা জিয়াকে আন্তরিকতার সঙ্গে খাদ্য গ্রহণের অনুরোধ করে বলেছিলেন, তার মেয়ে নিজ হাতে নাকি খালেদা জিয়ার জন্য রান্না করেছেন। এ সময় বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সুষমা তার মেয়েকে পরিচয়ও করিয়ে দেন। ফলে দলীয় সম্পর্কের বাইরেও একটি পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ওই সময় দুই বিরোধী নেতা দুই দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একান্ত আলাপ-আলোচনা করেন। আর এবার গত ২৫ জুন বাংলাদেশ সফরে এসে সুষমা আবারো বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে একান্ত আলাপে মিলিত হলেন। যা নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই।
বিশেষ কোনো দলের পক্ষে থাকবে না ভারত
গত ২৬ জুন ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক মুখপাত্র সৈয়দ আকবর উদ্দিন ঢাকায় এক প্রেস ব্রিফিং করেন। এতে তিনি বাংলাদেশ-ভারতের ভবিষ্যত সম্পর্ক নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেন। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না তার দেশ। বিশেষ কোনো দলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনও করবেন না তারা। বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার আলোকেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হবে।
আগামী দিনে বাংলাদেশের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক হবে, এমন প্রশ্নে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও সাংবাদিকদের একই জবাব দেন। তিনি বলেন, ভারতের নতুন সরকার সার্কের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। ভারত সরকার নির্দিষ্ট কোন দল নয়, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে চায়। বাংলাদেশে শক্তিশালী গণতন্ত্র দেখতে চায় ভারত। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের নতুন সরকারের এই দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যেসব নীতিনির্ধারণী বক্তব্য দিয়েছেন তাতে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেলো, কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশের একটি বিশেষ দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা ও রাখার যে নীতি গ্রহণ করেছিলো তা অনুসরণ করবে না বিজেপি সরকার। তারা বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে সম্পর্ক বজায় রাখবে। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল ভারতের কাছ থেকে অতীতের মতো অনৈতিক কোনো সুবিধা পাবে না। আর এতে বাংলাদেশে একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সহজ হবে।
সুষমার সফরে রাজনৈতিক প্রভাব
সুষমা স্বরাজের সফরকে যে যেভাবেই মূল্যায়ন করুক না কেন এ সফর যে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ প্রভাব ফেলবে এতে কারো দ্বিমত নেই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হবে না বলে সুষমা স্বরাজ যে মন্তব্য করেছেন এদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পট-পরিবর্তনের জন্য তা-ই যথেষ্ট। তার ওই বক্তব্যটিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। এটি এদেশের রাজনীতিতে বিশেষ প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করছেন তারা। এরা বলছেন, ভারতের এই অবস্থানগত পরিবর্তন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কারণ, এটা সবাই বোঝেন এবং বিশ্বাস করেন, ভারতের কংগ্রেস সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পক্ষে গত ৫ জানুয়ারি একতরফা একটি নির্বাচন করিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। কংগ্রেস সরকারের সরাসরি একগুঁয়ে সমর্থন না থাকলে ভোটারবিহীন ওই নির্বাচন করিয়ে নেওয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে হয়তো সম্ভব হতো না। ভারতের বর্তমান সরকার যদি বাংলাদেশের বিশেষ কোনো দলকে সমর্থন না দেয় তাহলে এদেশের জনগণ অচিরেই তাদের পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, এই সফরে বিশেষ একটি বার্তা নিশ্চিত করেছেন সুষমা স্বরাজ। তাহলো, বাংলাদেশের একক কোন দলের সঙ্গে নয়, বরং বাংলাদেশের দুই বড় দলের সঙ্গেই সমান সম্পর্ক রাখতে চায় ভারত। তিনি বলেন, এদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বার্তা দিয়েছে ভারত- যা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, সুষমা স্বরাজের এই সফরে পরিষ্কার হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে তারা যথেষ্ট সচেতন।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সুষমার সফরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। তাহলো বাংলাদেশের কোন নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না তার সরকার। যেমনটি কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল।
সেখান থেকে সরে গিয়ে বিজেপি সরকার বলতে চায়, সম্পর্ক হবে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে। তিনি বলেন, সেমিনারে দেয়া সুষমার বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। সেই বক্তব্যে সুষমা বলেছেন, গণতন্ত্রের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সহনশীলতার সংস্কৃতি, অংশগ্রহণ ও ভিন্নমতের বিকাশ প্রয়োজন। অনুরোধ পেলে এ ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা ও অনুসৃত আদর্শ সানন্দে বিনিময় করবো। এখন দেখা দরকার যে, এই বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে কোনো পরিবর্তন আসে কিনা। তিনি বলেন, আমি আশাবাদী, এক ধরনের সংলাপ হয়তো শুরু হতে পারে। আওয়ামী লীগের এখন উচিত হবে, যত দ্রুত সম্ভব আলোচনা শুরু করে দেয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম. শাহীদুজ্জামান সুষমার সফর প্রসঙ্গে বলেন, ভারত সব সময় তাদের নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। সুষমার সফরে সীমান্ত চুক্তি ও তিস্তা চুক্তি সম্পর্কে ইতিবাচক কোন আশ্বাস পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য রাজ্য সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ। কারণ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এটি কেন্দ্রীয় সরকারের বাস্তবায়নের কথা। কংগ্রেস সরকারের চুক্তিতে স্বাক্ষর করার সময় এটি চিন্তা করা উচিত ছিল।
আওয়ামী লীগের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার?
ঢাকায় ৪০ ঘণ্টার সফরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ দুই দেশের সাধারণ মানুষের জন্য কী মেসেজ দিয়ে গেছেন এমন প্রশ্ন এখন সবার মুখে। তার পুরো সফর নিয়েই তীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখেছেন সচেতন মহল। সবার মধ্যে কৌতূহল জেগেছে, কী বার্তা নিয়েছেন বা দিয়েছেন ভারত সরকারের প্রভাবশালী এ মন্ত্রী। রাজনৈতিক দলগুলো কে কি পেলো হিসাব কষা হচ্ছে। বিশেষ করে সরকার ও বিরোধী দলের বাইরে থাকা বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোন্ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে সুষমার, এটিই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
ভারতে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য দাওয়াতের চিঠি নিয়ে আসছেন, এটা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য ছিলো নিঃসন্দেহেই সুখকর সংবাদ। তাই শুরু থেকেই সরকার নানাভাবে এটিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচারের চেষ্টা চালিয়ে আসছিলো। পুরো পরিবেশটা তাদের পক্ষে রাখতে চাইছিলো। যেহেতু ভারতে ক্ষমতার পট-পরিবর্তনের পর এমন একটা কথা উঠে আসছিলো যে, কংগ্রেসের পরিবর্তে বিজেপি ক্ষমতায় আসাটা আওয়ামী লীগের জন্য সুখকর হবে না। যেহেতু কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগের সম্পর্ক বন্ধুত্বের এবং পারিবারিক, তাই বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক মধুর হতে পারে না। ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’ এই ফর্র্মুলা অনুযায়ী বিএনপির সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক ভালো হবে- এমন কথাই প্রচারিত হচ্ছিলো নানাভাবে। শুধু তাই নয়, এ ফর্মুলার বাইরে এমন কথাও প্রচারিত হচ্ছিলো যে, বিজেপি’র সঙ্গে বিএনপি’র সম্পর্ক পুরনো এবং বেশ ঘনিষ্ঠ। বিশেষ করে বিজেপি নেতা ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তারেক রহমানের সম্পর্ক বেশ আগের।
আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহল এমন কথাকে স্রেফ প্রচারণা বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইছিলো। কারণ এ কথাগুলো যদি মানুষ সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করতে শুরু করে তাহলে তা সরকারের জন্য কুঠারাঘাত হিসেবে দেখা দেবে। প্রশাসনের ওপর সরকার কর্তৃত্ব হারাবে। তাতে সরকারের পক্ষে আর বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব হবে না। এটা সবাই বোঝেন, এ সরকার টিকে আছে শুধুমাত্র প্রশাসনের ওপর ভর করেই।
তাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এমন কথা ব্যাপকভাবে বলার চেষ্টা করছিলো, ভারতে সরকার পরিবর্তন হলেও নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না। বরং বিজেপি সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক কংগ্রেস সরকারের চেয়েও গাঢ়ো হবে। ভারত তাদের স্বার্থেই আওয়ামী লীগকে জোর করে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার নীতি অনুসরণ করবে।
কিন্তু, আওয়ামী লীগ সুষমার সফরকে যেভাবে কাজে লাগিয়ে সংকট উৎরে উঠতে চেয়েছিলো সেটা সম্ভব হয়নি। সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। শুধু তাই নয়, উল্টো এখন আওয়ামী লীগের পায়ের তলার মাটিতেও টান পড়েছে বলা যায়।
আওয়ামী লীগ সরকার চেয়েছিলো, বেগম খালেদা জিয়া যাতে সুষমার সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো সুযোগ না পান। সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রাণান্তকর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিলো। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। সুষমা শুধু বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে একান্ত বৈঠকই করেননি ১২ মিনিটের ‘ক্লোজ ডোর’ বৈঠক করেছেন।
এদিকে মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার রায়কেও টেস্ট কেস হিসেবে নিয়েছিলো সরকার। সুষমার সফরকালে নিজামীর রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে জামায়াতকে উস্কে দিয়ে দেশে একটা কৃত্রিম অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চেয়েছিলো সরকার। যাতে ভারত জামায়াত-বিএনপির ওপর বিরক্ত হয়। কিন্তু, সরকারের সেই উদ্দেশ্যও সফল হয়নি। এটি নিয়ে সরকারকেই উল্টো বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। যতোটা জানা গেছে, নিজামীর রায় নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষাপটে ভারত থেকে সরকারের ওপরই বিরক্তি প্রকাশ করা হয়। যেহেতু এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে তাই সুষমার সফর পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলে ভারত সরকার। ফলে আওয়ামী লীগ সরকার তড়িঘড়ি করে অসুস্থতার ইস্যু দাঁড় করিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নিজামীর রায় স্থগিতের পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।
সুষমার সফর সরকারের জন্য সবচে’ বড় আঘাত হিসেবে দেখা দিয়েছে তাদের দেশের অবস্থান পরিবর্তনের ঘোষণা। ২৬ জুন ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক মুখপাত্র সৈয়দ আকবর উদ্দিন প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেন, এবার সম্পর্ক হবে “(বাংলাদেশ-ভারত) কান্ট্রি টু কান্ট্রি” সম্পর্ক। বিশেষ কোনো দলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক হবে না।
তিনি আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, তার দেশ ক্ষুদ্র দলীয় রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দুই দেশের সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে না। সম্পর্ক হবে “জনগণ টু জনগণ”। বাংলাদেশের জনগণ যে ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করবে ভারত সে ধরনের সরকারের সঙ্গেই কাজ করতে বেশি পছন্দ করে। কংগ্রেসের শাসন আমলে বাংলাদেশের সঙ্গে দলীয় ভিত্তিতে সম্পর্ক চালিয়ে আসছিল। মোদির সরকার কী তা-ই করবে? এমন প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দেন আকবর উদ্দিন। তিনি বলেন, ভারত কখনও দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় না।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরো বলেন, সম্পর্কের বিষয়টি ‘ফ্রেশ গ্রাউন্ড’-এ দেখতে চায় তার সরকার। এটি অবশ্যই দলীয় পর্যায়ে নয়, এটি হবে অবশ্যই জনগণের পর্যায়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ মুখপাত্রের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কংগ্রেস যেভাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করেছে তা থেকে সরে এসেছে নতুন সরকার। বলা যায়, আওয়ামী লীগের ওপর থেকে সেই একগুঁয়ে সমর্থন প্রত্যাহার করেছে ভারত। এটাই বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য একটি বড় ঘটনা।
মোদি সরকারের কাছে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত গত ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের খবর রয়েছে। আর সে কারণেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সফরকালে অনেক বিষয়ই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সুষমার এ সফর আওয়ামী লীগ তার সরকারের জন্য ইতিবাচক বলে উল্লেখ করলেও বার্তা অনেকটা ভিন্ন বলে উল্লেখ করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সুষমার এ সফরে স্পষ্ট হয়েছে ভারতের নতুন সরকার বিশেষ কোনো দলের প্রতি অনুগ্রহ দেখাবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক হবে “স্রেফ কান্ট্রি টু কান্ট্রি”। বাংলাদেশের জনগণ যে ধরনের সরকার চায় তার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক রাখবে ভারত। বিশ্লেষকরা বলছেন, কংগ্রেস সরকারের একান্ত ইচ্ছার কারণেই গোটা বিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পক্ষে একটি একতরফা নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছিল। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং কীভাবে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ ও আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছেন সেটা সবাই দেখেছে। কিন্তু ভারতের বর্তমান সরকার যদি বিশেষ কোনো দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে তৎপরতা না চালায় তাহলে বাংলাদেশে দ্রুতই একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সহজ হবে। সুষমা স্বরাজ একথা বলে গেছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করবে জনগণ। এতে তারা হস্তক্ষেপ করবে না। আর ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করুক বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও সেটাই চায়।