এসবিএন ডেস্ক দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের মাত্র ১ দশমিক ৮ ভাগ সময় ব্যয় হয়েছে আইন প্রণয়নে। অবশিষ্ট সময়ের বেশিরভাগ প্রাক্তন বিরোধীদলের (বিএনপি-জামায়াত) সমালোচনায় ব্যয় হয়েছে। এদিকে, ‘প্রধান বিরোধী দল’ সংসদ বর্জন না করলেও কোরাম সংকট উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। অধিবেশনে দৈনিক গড়ে ২৮ মিনিট কোরাম সংকটের কারণে নষ্ট হয়েছে। মোট ১৭ ঘণ্টা সাত মিনিট কোরাম সংকটে অপচয় হয়েছে ৮ কোটি টাকার বেশি।
গতকাল সোমবার সকালে দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। রাজধানীর মহাখালী ব্র্যাক ইন সেন্টারে এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দশম সংসদের ওপর ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ প্রতিবেদন’ প্রকাশ করে সংস্থাটি। পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সংসদকে কার্যকর করতে ১৮ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। মূল প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুলিয়েট রোজেটি এবং ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোরশেদা আক্তার। এ সময় টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন এডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিক হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
নবম ও দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনে দলীয় প্রশংসা হয়েছে ৮৫৬ বার, প্রাক্তন বিরোধী দলের (বিএনপি-জামায়াত) সমালোচনা করা হয় ৫৩১ বার, যেখানে নবম সংসদে প্রতিপক্ষ দলের সমালোচনা করা হয়েছিল ৩৪২ বার। সংসদে কোরাম সংকটের দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা কিছুটা কমে এলেও দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের উপস্থিতির ঘাটতির কারণে কোরাম সংকট এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। দৈনিক গড়ে ২৮ মিনিট কোরাম সংকটের কারণে নষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে সরকারের অংশ হয়েও বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) পরিচিতির প্রচেষ্টা সংসদকে একটি ‘ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য’ প্রদান করেছে। দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনে সংসদ নেতার উপস্থিতি ছিল ৮৮ দশমিক ৮৮ ভাগ (৩২ দিন) এবং বিরোধী দলীয় নেতার উপস্থিতি ছিল ৩৮ দশমিক ৮৮ ভাগ (১৪ দিন)।
জাতীয় পার্টিকে প্রধান ‘বিরোধীদল’ উল্লেখ করে বলা হয়, তারা সংসদ বর্জন না করলেও জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দৃশ্যমান ছিল না। দশম সংসদের একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সংসদের অনির্ধারিত আলোচনায় প্রধান বিরোধী দল এবং সরকারের মন্ত্রীপরিষদে সহাবস্থানকে কার্যকর সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিবন্ধক হিসেবে উপস্থাপন করেন। সংসদের অনির্ধারিত আলোচনায় অসংসদীয় ও অশালীন ভাষা ব্যবহার করে নবম সংসদের বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত, সমালোচনার প্রাধান্য লক্ষ্য করা গেছে।
টিআইবি বলছে, প্রথম অধিবেশনেই ৫১টি সংসদীয় কমিটি গঠিত হলেও বিরোধীদলের কোনো সদস্যকে কমিটির সভাপতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে কমিটিগুলোতে সদস্যদের সার্বিক গড় ইতিবাচক উপস্থিতি ছিল ৭৮ ভাগ। নবম সংসদের কয়েকজন মন্ত্রীকে দশম সংসদে একই মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির ফলে নবম সংসদের কোনো অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপন ও তদন্তের ক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিগত প্রভাব বিস্তার করার সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনে মোট কোরাম সংকট হয়েছে ১৭ ঘণ্টা সাত মিনিট, যার অর্থমূল্য প্রায় আট কোটি এক লাখ টাকা। অধিবেশনে আইন প্রণয়নে মোট সময়ের মাত্র ১ দশমিক ৮ ভাগ ব্যয় হয়েছে। অন্যদিকে সংসদ সদস্যদের আচরণবিধি সংক্রান্ত আইন ২০১০ এবং সংসদের স্থায়ী কমিটি (সাক্ষ্য গ্রহণ ও দলিলপত্র দাখিল) আইন-২০১১ নামে একটি বিলের খসড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তৈরি করলেও পাসের জন্য তা প্রথম অধিবেশনে উত্থাপিত হয়নি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংসদ সদস্যদের প্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহিতা কার্যক্রেমর আওতায় কার্যপ্রণালী বিধি ৭১-ক বিধিতে মোট ৭১টি জনগুরুত্বসম্পন্ন নোটিসের ওপর আলোচনা করা হয়। বিভিন্ন খাত ও প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত ৫টি মূলতবী প্রস্তাব অন্য পর্বে আলোচিত হবে এ মর্মে প্রত্যাখাত হলেও পরে তা নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। যেমন- নিয়োগ ও বোর্ডের প্রশ্নপত্র ফাঁস, মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা ক্রেস্টের জালিয়াতি, উপঢৌকন নিয়ে চীফ হুইফের বক্তব্য, পৌরমেয়র পদে বহাল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া, হলফনামায় দেয়া তথ্যের বাইরে অপ্রদর্শিত সম্পদ আহরণের অভিযোগ ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংসদে বিরোধী দলকে কোন গঠনমূলক আলোচনায় অংশ নিতে দেখা যায়নি।
সাংবাদিক সম্মেলনে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, সংসদের মূল কাজ জনস্বার্থে আইন প্রণয়ন করা, অথচ সংসদের কার্যাবলীর মধ্যে আইন প্রণয়নের হার দুই শতাংশেও পৌঁছায় না। এর কারণ ব্যবসায়ী অধ্যুষিত সংসদ। তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালে সংসদে আইনজীবী ছিলেন ৩৩ শতাংশ আর ব্যবসায়ী ছিলেন ১৮ শতাংশ। এখন ব্যবসায়ী ৬০ শতাংশ ও আইনজীবী ১৩ শতাংশ। এ জন্য জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে সংসদে আলোচনা হয় না। বরং ব্যবসায়িক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা ও আইন পাস হয়। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, চোখ বন্ধ রাখলেই কিন্তু প্রলয় বন্ধ থাকে না। এ সময় তিনি বলেন, আমরা জানি আজ বিকেল থেকেই আমাদের সমালোচনায় পড়তে হবে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আমরা কি দুর্ভাগা জাতি হিসেবেই বেঁচে থাকবো?’
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ‘বিরোধী দলের’ ভূমিকায় থাকলেও তারা সরকারেরই একটা অংশ। ‘সোনার পাথর বাটি’ হতে পারে না। হয়তো সোনার বাটি হবে। নয়তো পাথর বাটি হবে। মূলত জাতীয় পার্টি আত্মপরিচয় সংকটে রয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান বিরোধী দল শুধু নামে আছে। নিজেদের এক ধরনের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিরোধী দল হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে। মোটকথা বর্তমান সংসদে একটি অভূতপূর্ব অবস্থা বিরাজ করছে।
সংসদকে জবাবদিহিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার মাধ্যমে সংসদকে কার্যকর করতে বিরোধী দলকে আরো দৃশ্যমান ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান দশম জাতীয় সংসদ ব্যতিক্রম রূপধারণ করেছে। বিরোধী দলের যে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করা দরকার ছিল তা তারা করছে না। সংসদে সকল কার্যক্রম থাকলেও আমরা এ সংসদকে কার্যকর সংসদ বলতে পারছি না। তিনি আরো বলেন, বর্তমান সংসদের ‘প্রাক্তন’ বিরোধী দলকে অনেক অশালীন ভাষায় মন্তব্য করা হলেও স্পীকার তার অবস্থানে নীরব ছিলেন। এজন্য স্পীকারের ভূমিকাও কার্যকর নয়।
টিআইবি’র ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ প্রতিবেদনে সংসদীয় গণতন্ত্র সুদৃঢ় করা, সংসদকে কার্যকর করা ও সর্বোপরি সংসদকে জবাবদিহিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে সদস্যদের উপস্থিতি, তাদের গণতান্ত্রিক আচরণ ও অংশগ্রহণ, সংসদীয় কমিটি কার্যকর করা এবং তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত ১৮ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য সুপারিশসমূহ হলো- সংসদ অধিবেশনে সদস্যদের অনুপস্থিত থাকার সর্বোচ্চ সময়সীমা উল্লেখযোগ্যহারে কমিয়ে ৩০ কার্যদিবস করার বিধান করা; সদস্যদের স্বাধীন ও আত্মসমালোচনামূলক মতামত প্রকাশে ও ভোটদানে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা; আন্তর্জাতিক চুক্তিসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়ে সংসদে আলোচনা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া; সংসদ অধিবেশন ও স্থায়ী কমিটির সভায় সদস্যদের উপস্থিতিসহ সংসদ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে ও সময়মত ওয়েবসাইটে প্রকাশ; সংসদীয় কমিটির সুপারিশসহ কার্যবিবরণী জনগণ তথা সরকারি ও বেসরকারি রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রসহ সকল গণমাধ্যমে সহজলভ্য করা; কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়ার এক মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এই প্রতিবেদন সম্পর্কে মন্তব্য/আপত্তি লিখিতভাবে জানানোর বিধান প্রণয়ন; সুপারিশের আলোকে মন্ত্রণালয় কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা লিখিতভাবে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জানানোর বিধান এবং সংসদীয় কমিটিতে কোনো সদস্যের অন্তর্ভুক্তির ফলে স্বার্থের সংঘাতের অভিযোগ পাওয়া গেলে সে সম্বন্ধে যথাযথ অনুসন্ধান ও ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি উক্ত সদস্য মন্ত্রী হলেও তিনি সংশ্লিষ্ট আলোচনা বা ভোট দান থেকে বিরত থাকবেন এরকম বিধান প্রণয়ন করা।