
এসবিএন ডেস্ক. নানা আইনি জটিলতায় এবং আশ্রয়দাতা দেশগুলোর অসহযোগিতার
কারণে এতবছর বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হলেও এবার বুঝি তার
অবসান হতে যাচ্ছে। আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কানাডায় অবস্থানকারী আসামি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.)এম এইচ বি নূর চৌধুরী এবং যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে
থাকা কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নতুন করে উদ্যোগ
গ্রহণ করেছে সরকার। তবে প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়াতে এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়
রাষ্ট্রপক্ষের
আইনজীবী এবং বর্তমান আইনমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র
প্রতিমন্ত্রীও এ ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। ২০০৯ সালে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যরিস্টার শফিক আহমেদকে প্রধান করে
অান্তমন্ত্রণালয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানকে সপরিবারে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক ৬ খুনির মধ্যে ৪ জনের
অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স। ৬ বছরে ২ জনের অবস্থান নিশ্চিত
হলেও আইনি জটিলতায় তাদেরকে ফেরত আনা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পলাতক ৬ খুনিকে বর্তমান
সরকারের আমলে দেশে ফিরিয়ে আনা নিয়ে কাটছে না সংশয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল ( অব.) খন্দকার আব্দুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ( অব.) শরিফুল হক ডালিম, ক্যাপ্টেন(অব.) আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের কোনও সন্ধান জানা যায়নি।
এদের অবস্থান জানতে বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাস এবং ইন্টারপোলের মাধ্যমে
প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। নিজেদের আড়াল করতে হয়তো খুনিরা বারবার অবস্থান
পরিবর্তনের ফলেই সঠিক তথ্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
সূত্র। কানাডায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান না থাকায় নূর চৌধুরীকে হস্তান্তরে
দেশটি আগ্রহী নয়। এ বিষয়ে আইনি লড়াই চলছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে
বাংলাদেশের বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকায় রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে সমস্যা
হচ্ছে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, এ বিষয়ে কিছু বলবো না এবং বলতেও পারবো না। কারণ, তাদের অানা নিয়ে কথা হচ্ছে। এখন আমি যদি কিছু বলতে যাই তাহলে আমার উদ্যোগ বা কার্যক্রম যেটাই
বলি সেটা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এ বিষয়ে কিছু বলা আমার ঠিক হবে না। তবে আইন মন্ত্রণালয়ের একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় , খুব শিগগরই এদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং বাকিদের
ফিরিয়ে আনতে টাস্কফোর্সকে শক্তিশালী করা হয়েছে। ইতিমধ্যে কানাডায় পলাতক আসামি নূর চৌধুরীর পাসপোর্ট জব্দ করেছে ওই
দেশের সরকার। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আইনি
লড়াই শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে আইনজীবী নিয়োগ করে তাদের ফিরিয়ে
আনার উদ্যোগ নেয় গত সরকার। এই উদ্যোগেরই ধারাবাহিকতায় এই দুজনকে দেশে আনার বিষয়টি
আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে স্পষ্ট হবে বলে জানা গেছে। আইন মন্ত্রণালয় সূত্র আর ও
জানায়, মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামিকে নিজ দেশে ফেরত না পাঠানোর যে নীতিতে
কানাডা বিশ্বাসী, তারা সেই অবস্থান পরিবর্তন করবে বলেই মনে করছেন। অপরদিকে
মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আরেক খুনি যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রাশেদ চৌধুরীকে দেশে আনার
বিষয়েও তারা আশাবাদী। অপরদিকে বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর
সাজাপ্রাপ্ত খুনিদের দেশে ফেরত আনার উদ্যোগের ব্যাপারে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
শাহরিয়ার আলম বলেছেন, আমরা অন্যের আইনকে শ্রদ্ধা করি। আমাদের আইনকেও অন্যদের শ্রদ্ধা করা
উচিত।
‘যদি দুই দেশ সম্মত হয় তাহলে যত আইন-কানুন
থাকুক, খুনীদের দেশে ফেরাতে সমস্যা হবে না। সরকার সেই পরিকল্পনা মতোই
আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’ সরকারের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, খুনি আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন ২০০২ সালে। খন্দকার আবদুর
রশিদ লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির আশ্রয়ে ছিলেন। লিবিয়ার বেনগাজিতে গাদ্দাফি
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ব্যবসাও ছিল তার। কিন্তু গত বছর লিবিয়ায় রাজনৈতিক
পটপরিবর্তনের পর খুনি রশিদ এখন কোথায় আছেন তা স্পষ্ট নয়। শরিফুল হক ডালিম
বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থান করছেন। বাকিরা বারবার নিজেদের অবস্থান পাল্টাচ্ছেন
বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ধারণা। ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন ২০০১ সাল পর্যন্ত ভারতে
পালিয়ে ছিলেন বলে সরকার মনে করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় এ
বিষয়টি উঠেছে। ভারত ওই খুনিদের অবস্থান সম্পর্কে বাংলাদেশের কাছে আরও তথ্য
চেয়েছে। কিন্তু এরপরও সেখানে তাদের অবস্থান বা সমর্পণ বিষয়ে ইতিবাচক কোনও খবর
জানা নেই সংশ্লিষ্টদের। খুনি ডালিম ২০০৯ সালের শেষ দিকে
কানাডায় গিয়েছিলেন বলে দেশটির সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেছে, কানাডা থেকে কয়েক দিন পরই তিনি হংকং হয়ে আবার পাকিস্তানে ফিরে
গেছেন। তিনি ব্রিটিশ পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন।
ফ্ল্যাশব্যাক: একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার
তিন প্রধান আসামি বরখাস্ত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন
ঠাকুরকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএ)এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের
ঘটনায় এফআই আর
করেন ধানমণ্ডি থানায়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাঁচাতে হওয়া ইনডেমনিটি আইন বাতিল হয় ১৯৯৬ সালের ১৪
নভেম্বর। পরের বছর ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য
মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামির
উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়। তবে বিচারক বিব্রতসহ নানা কারনে ১৯৯৭ সালের ১৯
জুন পর্যন্ত বিচার কার্যক্রম আটবার স্থগিত হয়। অবশেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর
মামলার রায়ে বিচারপতি কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড
প্রদান করেন।
অন্যদিকে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর
হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় দেয়।
বিচারপতি এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত
১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বজায় রাখেন এবং অপর বিচারক এ বি এম
খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি
বিভক্ত রায়ের ফলে একই বছরের ৩০ এপ্রিল তৃতীয় বিচারক মোহাম্মদ ফজলুল করিম ২৫ দিন
শুনানির পর অভিযুক্ত ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিত করেন।
পরবর্তীতে
২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলে বিচার কাজ বন্ধ
থাকে। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের
শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।
২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর ২৯ দিনের
শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ
নির্ধারণ করেন। ওইদিনেই বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের
বেঞ্চে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা
আপিল আবেদন খারিজ করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে
আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে
জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়।