মোশাররফ হোসেন মুসা ..
স্যামুয়েল হান্টিংটন ১৯৯৩
সালে ‘
সভ্যতার সংকট’
নামক এক গবেষণা গ্রন্থে বলেছেন- ‘
ঠান্ডাযুদ্ধ পরবর্তী
বিরোধ মতাদর্শগত কিংবা অর্থনৈতিক কারণে হবে না,
সংস্কৃতিগত কারণে সংঘটিত হবে।’
সেজন্য তিনি সাত-আটটি
প্রধান সভ্যতাকে সমন্বয় করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু মার্কসবাদীরা বহু আগে থেকেই
বলে আসছেন- ‘
সকল দ্বন্দ্বের পেছনে কাজ করে অর্থনৈতিক
দ্বন্দ্ব। অর্থনীতিই সংস্কৃতি নির্মাণ করে। অর্থাৎ অর্থনীতি হলো মৌলিক উপাদান,
আর সংস্কৃতি হলো তার উপরিকাঠামো। ধর্মকে যতই গুরুত্বের চোখে
দেখা হোক না কেন এটি একটি সংস্কৃতি ছাড়া কিছু নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পের বিকাশ
হলে প্রচলিত ধর্মগুলো আপনাআপনি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সেকারণে ধর্মযুদ্ধ বলতে অতীতে
কিছু ঘটেনি,
ভবিষ্যতেও ঘটবে না।’
তবে মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে,
সেখানে ভুমির চেয়ে ধর্মই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। বলা যায়,
সেখানে উপরিকাঠামো বেসিক কাঠামোকে শুধু প্রভাবিতই করছে না,
মাঝে-মধ্যে অস্বীকারও করতে চাচ্ছে। মুসা (আঃ) এর অনুসারীরা ইহুদি জাতি হিসেবে
পরিচিত। জায়ন (তরড়হ) শব্দটির অর্থ হলো পবিত্র জেরুজালেম। ইহুদিরা জেরুজালেমকে
পবিত্র প্রতিশ্রুত ভুমি এবং আব্রাহামকে তাদের আদি পুরুষ মনে করে। জেরুজালেমে
ইহুদিরা হযরত সোলায়মানের মাজার,
মুসলিমরা আল আক্সা মসজিদ আর
খ্রীস্টানরা সেপুলক্রে গীর্জা তৈরি করে। নৃতাত্ত্বিকদের মতে,
আজ থেকে চার কিংবা সাড়ে চার হাজার বৎসর পূর্বে কেনান রাজ্যে (বর্তমানে
প্যালেস্টাইন) মুসা (আঃ) এর জন্ম ঘটে। সেসময় মিশরের শাসনকর্তা ছিলেন ফারাও বংশের
ফেরাউন। ফেরাউনের দাসত্ব থেকে তাঁর অনুসারীদের মুক্ত করাতে গিয়ে তিনি ফেরাউনের
সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তী সময়ে
রোমানদের আক্রমণে তার অনুসারীরা ভ’
মিচ্যুত হন এবং বিভিন্ন
দেশে ছড়িয়ে পড়েন। ইহুদিরা বিশ্বাস করে তাদের প্রতি নবীর নির্দেশ ছিল- ‘
রাষ্ট্র নিপীড়ক যন্ত্র। তোমরা ব্যবসাকে গুরুত্ব দিবে।’
অনেকে মনে করেন,
ইহুদিদের ব্যবসাকে গুরুত্ব দেওয়ার পিছনে ধর্মীয়
অনুপ্রেরণা রয়েছে। ইহুদিরা যেখানেই গেছে সেখানেই তাদেরকে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক
হতে দেখা যায়। কিন্তু সেই অর্থ জনহিতকর কাজে ব্যয় না হওয়ায় স্থানীয়দের সঙ্গে এক
প্রকার দুরুত্ব তৈরি হয়। জার্মান,
রাশিয়া সহ অন্যান্য
ইউরোপিয়ান দেশ সমূহে তাদের প্রতি আক্রোশের পিছনে এই জনবিচ্ছিন্নতাকে দায়ী করা যায়।
উনিশ শতকের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত প্রথম জায়নবাদী কংগ্রেসে কয়েকজন ইহুদি বুদ্ধিজীবী
আক্ষেপ করে বলেন- ‘
আমরা শত-শত বৎসর যাবৎ একটি দেশে বসবাস করেও
স্থানীয়দের আপন হতে পারিনি। সেজন্য আমাদের উচিত হবে যে দেশ থেকে আমাদের উৎপত্তি
ঘটেছে সে দেশে চলে যাওয়া।’
১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্ব
যুদ্ধের সময় অটোমান সা¤
্রাজ্যের পতনের সুযোগে তারা
ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে এবং পরবর্তী সময়ে বৃটিশ ও জাতিসংঘের
সহযোগিতায় জেরুজালেম এলাকায় বসবাসরত
মুসলিম ধর্ম বিশ্বাসীদের নানা কৌশলে বিতাড়ন করে আলাদাভাবে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা
করে। ১৯২১ সালে সেখানে ইহুদি সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ হাজার। অভিবাসীদের কারণে সেই সংখ্যা
বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখ। ইহুদিরা মনে করে-‘
তারা হলেন হযরত ইব্রাহীমের (আব্রাহাম) প্রথম স্ত্রী সাহারার
বংশ লতিকা তথা ইসরাইল জাতির প্রধান ধারা। আর মুসলিমরা হলো ইব্রাহীমের দ্বিতীয়
স্ত্রী বাদিনী হাজেরার বংশের।’
তারা আরও গর্ব করে বলেন- ‘
ইহুদিরাই একেশ্বরবাদের আদি জনক। ইসরাইল জাতি থেকে প্রায় সকল নবী-রাসুলের জন্ম
ঘটেছে। আর অ্যারাবিয়ান বংশ লতিকায় মাত্র একজন নবীর আবির্ভাব ঘটেছে।’
বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে ইহুদিদের সংখ্যা মাত্র ১ কোটি ২৫ লাখ। কথিত আছে,
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চালায় সমগ্র বিশ্বকে। আর মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রকে পরিচালনা করছে ইহুদি ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবীরা। বিভিন্ন সূত্রে জানা
গেছে,
বিশ্বে বিজ্ঞানে এ পর্যন্ত যত আবিস্কার হয়েছে
তার চল্লিশ ভাগের দাবিদার এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে থাকার পরেও
ফিলিস্তিনিদের বেলায় কেন যে তারা জায়নবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছে,
আবার কেন যে তারা দীর্ঘ দুই হাজার পর পূর্ব পুরুষদের জন্ম স্থানে ফিরে আসলো-
তা এখন গবেষণার বিষয় । যদিও তারা নিজ দেশে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম
হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন,
কঠিন শর্তাবলী ও ধর্মীয়
আচার-আচরণ তথা জন্মসুত্রে ইহুদি হতে হয়
বলে এই ধর্মের বিকাশ ঘটেনি (যা অনেকটা
হিন্দু ধর্মের মতো)। গত দুই মাসে তাদের নির্বিচার বোমা বর্ষনে প্রায় ২ হাজার
ফিলিস্তিনির মৃত্যু ঘটেছে। এর বিপরীতে তাদের ৭৬ জন সৈন্যের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের বক্তব্য হলো-‘
আমরাই এখানকার পুরাতন ও স্থায়ী অধিবাসী। ইহুদিরা বহিরাগত। তারা বাতিল ধর্মের
লোক।’
বর্তমান হামাস দাবী করছে ইহুদিদের বিরুদ্ধে
তাদের আন্দোলন ধর্মীয় কারণে নয়। কিন্তু তাদের দলীয় আদর্শে রয়েছে ইহুদিদের উচ্ছেদ
করে সেখানে বৃহত্তর ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের কথা। ধর্মীয় রাষ্ট্র ইরান বহু আগেই ঘোষণা
দিয়ে রেখেছে- ‘
পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ইহুদি নামক রাষ্ট্রের নাম
মুছে ফেলতে হবে।’
মধ্যপ্রাচ্যের সংকট প্রসঙ্গে মুসলিম প্রধান
দেশগুলোর বক্তব্যও ধর্ম নিরপেক্ষ নয়। বাংলাদেশের বড় দলগুলোর শীর্ষ নেতারা বহুবার
বলেছেন- ‘
ফিলিস্তিনি জাতির পক্ষে মুসলিম উম্মাহকে
ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
ধর্ম নিরপেক্ষবাদী বুদ্ধিজীবীদের মুখেও শোনা
যায়- ‘
ইসরাইলের চারপাশে এতগুলো মুসলিম দেশ থাকতে
ক্ষুদ্র ইহুদি রাষ্ট্রটি টিকে থাকে কিভাবে !’
মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে আইএস (ইসলামিক স্টেট) নামে আরেকটি উগ্রবাদি ইসলামী দলের
উদ্ভব ঘটেছে। তারা ইরাক ও সিরিয়ায় বসবাসরত অন্য ধর্মাবলম্বীদের হুমকি দিয়ে বলেছে- ‘
মুসলিম ধর্ম গ্রহণ কর অথবা দেশ ত্যাগ কর।’
তাদের হাতে ইতোমধ্যে দুই শতাধিক ইয়াজেদি সম্প্রদায়ের লোক ও ১ জন মার্কিন
সাংবাদিকের প্রাণহানী ঘটেছে।
আরব দেশে তেল সম্পদ আবিস্কৃত হওয়ার আগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দেশ দখলের চিন্তা করেনি। তারা এখন তেল
সম্পদ দখলে রাখার স্বার্থে এক হাতে ধর্মীয় উগ্রবাদের জন্ম দিচ্ছে আর অন্যহাতে সেটি
দমনের নামে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা খেলছে। এক্ষেত্রে মার্কসবাদীদের বক্তব্যই সঠিক। তবে
অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের কথা বলে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বকে অবহেলা করে চুপ করে বসে থাকলে
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই লাভবান হবে। এখন প্রয়োজন, যাবতীয় অজ্ঞানতা ও কূপমন্ডুকতা দূর করার উদ্দেশ্যে উপযুক্ত গণতান্ত্রিক ও
সাংস্কৃতিক লড়াই চালিয়ে যাওয়া। ধর্মের উৎপত্তি পরকালের ভীতি থেকে হলেও সভ্যতার
দীর্ঘ যাত্রায় এটি সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। মনে রাখা দরকার,
এর বিকল্প অথবা এর চেয়ে উন্নত সংস্কৃতি না আসা পর্যন্ত এর
গুরুত্ব অস্বীকার করা আত্মঘাতী হবে।