Latest News

সম্প্রচার নীতিমালা: গণমাধ্যমের আকাশে কালো মেঘের ছায়া

নেছার আহমদ জামাল 
তোবার গার্মেন্ট শ্রমিকরা যখন ন্যায্য পাওনা আদায়ের সংগ্রামে নিয়োজিত, উত্তাল পদ্মায় যখন লঞ্চ ডুবিতে শত শত মানুষের সলিল সমাধি হচ্ছে তখন (৪ আগস্ট ২০১৪) মন্ত্রিসভার বৈঠকে বহুল আলোচিত সম্প্রচার নীতিমালা অনুমোদন করা হয়েছে। এ নীতিমালার আলোকে আইন করা হবে, যার মাধ্যমে একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠিত হবে। গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদেরও দীর্ঘদিনের দাবি ছিল এ সংক্রান্ত একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালার। যে নীতিমালাটি ইতোমধ্যে প্রণীত ও মন্ত্রিসভায় গৃহীত হয়েছে।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজের পূর্বশর্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং আমাদের সংবিধান এ ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ নিশ্চয়তা দিয়েছে। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার কারণেই আজ বিশ্ব এত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
সরকারপন্থী বিএফইউজের নেতারা এ সম্প্রচার নীতিমালার প্রশংসা করলেও কমিশন গঠনের সময়সীমা নির্ধারণ না করা এবং কমিশন-সম্পর্কিত আইন না হওয়া পর্যন্ত তথ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে সিদ্ধান্তের ক্ষমতা রাখা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সম্প্রচার কমিশন গঠনের আগে এই নীতিমালার কোনও ধারা প্রয়োগ না করার জন্যও সরকারের প্রতি তারা আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে কমিশনের মাধ্যমেই যত শিগগির সম্ভব নীতিমালাটি চূড়ান্ত করারও আহ্বান জানান।
এ নীতিমালার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ড. ইউনুস আলী আকন্দ গত ১৮ আগস্ট ২০১৪ হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। তিনি বলেন,  ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এটি সংবিধানের ১১, ২৬ ও ৩৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’
আমাদের সংবিধান বলছে, নিয়ন্ত্রণ করতে হবে আইন দিয়ে, নীতিমালা দিয়ে নয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ কেবল আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে বাক-স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। সুতরাং গণমাধ্যমের ওপর কোনও বাঁধা-নিষেধ আরোপ করতে হলে তা অবশ্যই আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই করতে হবে।
এ নীতি প্রসঙ্গে সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, তারা সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এবং সবার মতামতের ভিত্তিতে এ নীতিমালা প্রণয়ন হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল, ছয় মাস ধরে ওয়েবসাইটে খসড়া নীতিমালাটি ছিল। কিন্তু কারো মতামত নেওয়া হয়নি। এমনকি যাদেরকে নীতিমালা প্রণয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখা হয়েছিল তাদের অনেকেরই মতামত গৃহীত হয়নি। তাদের অধিকাংশই কিন্তু আবার সরকার পক্ষের লোক। অনেকে এই অভিযোগও তুলেছেন যে, তারা সর্বশেষ যে খসড়া তৈরি করে ছিলেন সেই কপি মন্ত্রিসভায় উত্তাপিত হয়নি।
সম্প্রচার নীতিমালায় বলা হয়েছে- কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত বা গোপনীয় বা মর্যাদাহানিকর তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। এখানে ‘মর্যাদাহানিকর’ এর সংজ্ঞা কী হবে? কোন ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা এমডি যদি ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা লুটপাট করেন তবে কি এই সংবাদ প্রকাশ করা যাবে না? রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা যেসব অপরাধমূলক কাজ করেন, যেমন টেন্ডারবাজি, জবরদখল, দুর্নীতি ইত্যাদি- তাও কি প্রকাশ করা যাবে না? কারণ এটা প্রকাশ করলে তো বিশেষ ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুণœ হতে পারে। নীতিমালায় বলা হয়েছে- বিচারিক ক্ষমতা আছে এমন সরকারি কর্মকর্তা ডিসির বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। যে জেলা প্রশাসকরা সাংবাদিক নঈম নিজামদের মত খ্যাতিমান মানুষদেরকে পিস্তলের লাইসেন্স না দিয়ে নূর হোসেনদেরকে দিয়ে সেভেন মার্ডারের নায়ক বানান তাদের খবরও কি গোপন রাখতে হবে?
সম্প্রচার নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে- সশস্ত্র বাহিনী অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত দায়িত্বশীল অন্য কোনো বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ, বিদ্রূপ বা অবমাননা করা যাবে না। সামরিক বিষয় সংক্রান্ত কোনো গোপনীয় তথ্য প্রকাশ করলে তার জন্য গুরুতর শাস্তির বিধান অন্যত্র আছে। এর জন্য নতুন করে সম্প্রচার নীতি প্রণয়নের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। কিস্তু পুলিশ বা র‌্যাব যদি কাউকে ক্রসফায়ার অথবা বন্দী অবস্থায় নির্যাতন করে তাহলেও কি সে তথ্য গোপন করা হবে? খালেদা জিয়ার (২০০১-২০০৬) শাসনকালে যৌথবাহিনীর অপারেশন ক্লিনহার্ট এর কথা এখোনো সবার মনে আছে। তখন খালেদা জিয়া পার্লামেন্টে আইন করে যৌথবাহিনীর নির্যাতনকারীদের দায়মুক্তি দিয়েছিলেন। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি একই ভাবে কোন বিশেষ বাহিনীর অপরাধীদের সুবিধা করে দিচ্ছেন? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন প্রকাশ্যে রাজপথে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মরহুম আবদুস সামাদ আজাদ, মরহুম আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ নাসিম, মতিয়া চৌধুরীসহ বরেণ্য রাজনীতিবিদদের লাঠিপেটা করেছিল সেদিন এই গণমাধ্যমগুলো কি আপনাদের তথা সত্যের পক্ষে দাঁড়ায়নি?
এ নীতি যদি আগে থেকেই থাকত তাহলে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় গোয়েন্দা সংস্থার বা নিরাপত্তা বাহিনীর যুক্ত থাকার খবর বা নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মামলা, লিমনের নির্যাতন, মিরপুরে পুলিশি নির্যাতনে ঝুট ব্যবসায়ীর মৃত্যু ইত্যাদি কিংবা অতীতের একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, মঞ্জুর হত্যা মামলার তথ্য, ঢাকা সিটি কলেজের ইনজামামুল হক জিসানের ওপর পুলিশের নির্যাতন, সুনামগঞ্জের ছাতক পৌর চেয়ারম্যানের ভাই কামাল আহমেদ চৌধুরীকে পুলিশের নির্যাতন প্রকাশ করা যেত না।
নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে- টকশোতে বিভ্রান্তিমূলক ও অসত্য তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। গত ২২ আগস্ট ২০১৪ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ে তৃতীয় মাত্রা অনুষ্ঠানে বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ বলেন- ‘...এখন আমরা বুঝতে পারছি না আসলে কোনটি বিভ্রান্তিকর তথ্য। কারণ আওয়ামীলীগ বলছে ড. ইউনূসের জন্য পদ্মা সেতু হয়নি। আর আমি বলছি আবুল হোসেনের জন্য পদ্মা সেতু হয়নি। আবার আওয়ামীলীগ বলেছে ছাত্রলীগ বিশ্বজিৎকে হত্যা করেনি। কিন্তু আমরা বলেছি বিশ্বজিৎকে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরাই হত্যা করেছেন। তাহলে কোনটি বিভ্রান্তিকর?’

একই বিষয়ে ৬ আগস্ট ২০১৪ বাংলাদেশ প্রতিদিনে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন ‘...৫ জানুয়ারি তথাকথিত নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করি। এটা কি কোনো নির্বাচন? শতকরা ৪০ ভাগ ভোট পড়েছে? দেশের মানুষ দেখেনি? কোন তথ্যটি বিভ্রান্তমূলক? মাত্র ৫ ভাগ ভোট পড়েছে নাকি ৪০ ভাগ? বিভ্রান্তি কি টকশো’র অতিথি বক্তারা ছড়াচ্ছেন নাকি সরকার নিজে?’
নীতিমালার আরেকটি বিষয় হলো- বন্ধুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন কিছু বলা যাবে না, যাতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু বন্ধুরাষ্ট্র কারা? যদি বলা হয় ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট,্র তবে বলতে হয় ভারত নি:সন্দেহে আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত যে সাহায্য করেছিল, তা আমরা কখনোই ভুলতে পারব না। কিন্তু তাই বলে ভারত যদি আমাদেরকে নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করে অথবা সীমান্তে ফেলানিদের হত্যা করে কাটা তারে লাশ ঝুলিয়ে রাখে সেই খবরও কি প্রকাশ করা যাবে না?
সম্প্রচার নীতিমালা কার্যকর হওয়ার আগেই সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী গত ৯ আগস্ট ২০১৪ শনিবার সিলেটের এক সভায় অসতর্ক মুহূর্তে সরকারের আসল অভিসন্ধি ফাঁস করে দিয়েছেন। সেই সাথে তিনি সাংবাদিকদের এমন ভাষায় গালিগালাজ করেছেন যা কোন সভ্য সমাজে উচ্চারণ করার মত নয়। তিনি হুমকি দিয়েছেন- সম্প্রচার নীতি কার্যকরী হোক, তিনি সাংবাদিকদের দেখে নেবেন। পরে তিনি অবশ্য ক্ষমা চেয়েছেন। তবে অস্বাভাবিক রাগত অবস্থায় মুখ ফসকে আসল কথাটা বেরিয়ে এসেছে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে মানুষ যখন অতিরিক্ত রাগত অবস্থায় থাকে অথবা মহা সুখে বা দু:খে অতি আবেগপ্রবণ হয় তখন তার অবচেতন মন থেকে তার মনের ভেতর লুকিয়ে রাখা কথাটি বেরিয়ে আসে।
ইদানিং আবার সাংবাদিকদের উপর ব্যাপক ধর-পাকড় শুরু হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বর্তমানে এআইজি (ভারপ্রাপ্ত) প্রলয় কুমার জোয়ার্দারের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করায় দৈনিক ইনকিলাবের বার্তা সম্পাদক রবিউল্লাহ রবিকে গত ১৯ আগস্ট ২০১৪ রাতে তার অফিস থেকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অনিয়মের বিরুদ্ধে পত্রিকায় একাধিক সংবাদ প্রকাশ করায় সিলেটে পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত তানিয়া ইয়াসমিন মণি নামে এক তরুণীকে দিয়ে ১৯ আগস্ট ২০১৪ তারিখে মামলা করার কয়েক ঘণ্টা আগেই সিলেটের সিনিয়র সাংবাদিক ও দৈনিক মানবজমিনের বিশেষ প্রতিনিধি চৌধুরী মুমতাজকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পটুয়াখালী সওজের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হাসান আল মামুনের দুর্নীতির সংবাদ প্রচার করায় তিনি চাঁদাবাজির মামলা করলে বাংলাদেশ প্রতিদিন ও দেশ টিভির পটুয়াখালীর প্রতিনিধি সঞ্জয় কুমার দাস এবং মাছরাঙা টিভির পটুয়াখালী প্রতিনিধি জলিলুর রহমান জলিলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। যদি এই ধর-পাকড় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয় তবে আমাদের কোন কথা নেই, আর যদি সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিফলন হয় তবে সেটা চিন্তার বিষয় বটে।
ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট, রাজনীতি বিশ্লেষক কুলদীপ নায়ার গণমাধ্যম সম্পর্কে বলেছেন- ‘ধ্র“ব সত্য যে, গণমাধ্যম হচ্ছে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। এটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি দিক নির্দেশ করে, যা কিনা স্বাধীন সমাজকাঠামোর বাহক। প্রেস ও টিভি চ্যানেল উভয় গণমাধ্যম নিশ্চিত করে যে জনগণ হচ্ছে মনিব এবং তারা ক্ষমতা চালনা করে নেতাদের মাধ্যমে, যারা শাসন বা অপশাসন কোনোটিই করে না। এটি হচ্ছে ব্যালট বাক্সের পবিত্রতা, যা গণনা করা হয়। আর গণমাধ্যম হচ্ছে এর রক্ষক।’ অতএব মুখে শুধু গণতন্ত্রের কথা বললে হবে না, গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য গণমাধ্যমকে স্বাধীন ও শক্তিশালী রাখতে হবে। যত দামী গাড়ী হোক না কেন, যদি তার তিনটা চাকা ভালো থাকে আর একটি চাকা ফুটো থাকে তাহলে যেমন এই গাড়ী চালানো সম্ভব নয় তেমনি স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্রকে সচল রাখা সম্ভব নয়। নোবেলবিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘স্বাধীন সংবাদপত্র দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধেও প্রাচীর গড়ে তুলতে পারে।’ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংসদে কার্যকর বিরোধী দল, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও দলীয়করণমুক্ত প্রশাসন এবং স্বাধীন গণমাধ্যম অত্যন্ত জরুরী।
স্বনামধন্য সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান ২৩ আগস্ট ২০১৪ বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ হঠকারিতা না ষড়যন্ত্র’  শিরোনামে একটি পর্যবেক্ষণ লিখেছেন। এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা সাংবাদিকতায় জড়িয়ে যাওয়ার পরে অনেক নিউজ কাভারেজ করতে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার সাথে গেছেন। এ বিষয়ে তিনি সব সময়ই বলেন শেখ হাসিনার সরকার মিডিয়া বান্ধব, তার সাথে সাংবাদিকরা গেলে তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে শেখ হাসিনা নিজে খোঁজ-খবর নেন। সম্প্রচার নীতিমালা বিষয়ে তিনি নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন রাখছেন- ’৯৬ শাসনামলে যে শেখ হাসিনা নিয়মিত সম্পাদকদের নিয়ে কিংবা সিনিয়র সাংবাদিকদের ডেকে ব্রেকফাস্ট করতেন, সেনা শাসন জমানায় যে শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে অনেক ব্যাপারে ডিকটেশন দিতেন, গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতায় যিনি ছিলেন সোচ্চার ও বিশ্বাসী; আজ তার সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে কেন এই উদ্যোগ নিচ্ছে? ক্ষমতা এমনিতেই শাসকের চোখের সামনে দিনে দিনে কাঁচের দেয়াল তুলে দেয়। স্তাবক-মোসাহেবরা প্রশংসার স্তুতিবাক্য গাইতে গাইতে কাঁচের দেয়াল কালো করে দেন। জনগণের চোখের ভাষা, মনের ভাষা আর তখন পড়তে পারা যায় না। ‘... মাগুরার ভোট ডাকাতির খবর এ দেশের প্রিন্ট মিডিয়া বিএনপি জমানায় ফলাও করে প্রচার করেছিল বলেই তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে সাফল্য কুড়িয়েছিলেন। বাংলাভাই বা জঙ্গিবাদের খবর সংবাদপত্রই তুলে এনেছিল। সেদিনের বিএনপির মন্ত্রীরা বলতে চেয়েছিলেন বাংলাভাই মিডিয়ার সৃষ্টি। কিন্তু মিডিয়াই প্রমাণ করেছিল বাংলাভাই কাদের সৃষ্টি।’
একেবারে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে রাজনীতি করার সুবাধে পীর হাবিবুর রহমানের অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক ভারী। তাই তার অভিজ্ঞতার আলোকে এর পরিণতি ব্যাখ্যা করতেও ভুল করেননি। তিনি বলেন-‘... কিন্তু সেদিনের ইত্তেফাক বা সংবাদ যতটা না সংবাদ মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে তার চেয়ে বেশি খবর গ্রাম থেকে গ্রামে চলে গেছে মানুষের মুখে মুখে। ...বঙ্গবন্ধুর উদারতার সুযোগে গণকণ্ঠ মিথ্যাচার, অপপ্রচারের দর্পণ হয়ে উঠেছিল। সাময়িক উত্তেজনার জাসদ ও গণকণ্ঠ বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। গণমানুষের আকাঙ্খার বাইরে কী রাজনৈতিক শক্তি, কী গণমাধ্যম কোনোটাই টিকতে পারে না। জাসদ ও গণকণ্ঠের পরিণতিও তাই হয়েছিল।’
এ কথা ধ্র“ব সত্য যে, মানুষের মুখে মুখে যেটা প্রচার হয় সেটাকে কোন ভাবেই আটকানো যায় না, আর মানুষ এতে নুন মসলা লাগিয়ে তিলকে তাল বানিয়ে প্রচার করে। আর অবাধ তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে মুখে মুখে রটে যাওয়াটাকে আটকে রাখা, সেটাতো প্রায় অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হবে না।
সম্প্রচার নীতিমালা একটা, অনলাইন নীতিমালা একটা, ১৯৭৪’র নিউজ পেপার সার্ভিসেস অ্যাক্ট একটা, তথ্য মন্ত্রণালয় প্রেস কাউন্সিলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অভিযোগ নেয়ার জন্য আরেকটা, এরকম আলাদা আলাদা নীতিমালা হয় না। তাই এখন দাবি উঠেছে পৃথক পৃথক ভাবে না করে গণমাধ্যমের জন্য একটি সমন্বিত অভিন্ন নীতিমালা ও আইনের।
গত ১০ আগস্ট ২০১৪ ‘আর্টিকেল ১৯’ কর্তৃক আয়োজিত ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪: উদ্বেগ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় সম্প্রচার ও অনলাইন উভয় নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তফা জব্বার বলেন ‘আলাদা নীতিমালা কেন? তার মানে কাগজে কাউকে আমি গালি দিতে পারবো। কিন্তু অনলাইনে পারবো না? আমি মনে করি, সামগ্রিকভাবে মিডিয়ার জন্য একটি কমন প্লাটফর্ম দরকার। তাই সম্প্রচার কমিশন নয়, গণমাধ্যম কমিশন হওয়া উচিত। এটা করা হলে কমিশনের কাছে কাগজ-টিভি সবার বিষয়ে যেতে পারবো।’
তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তফা জব্বার প্রথম যখন বাংলাদেশ সরকারকে ফ্রি সাইবার অপটিক্যালে সংযুক্ত হওয়ার কথা বললেন তখন কেউ তাঁর কথা শুনেনি। যখন শুনলো তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। অবশ্য না শুনার কথা, কারণ ব্যাপারটি তখনও সরকার অনুধাবন করতে পারেনি। ২০০২ সালের মার্চ বা এপ্রিলে সিলেটের হাফিজ কমপ্লেক্সে আনন্দ মাল্টিমিডিয়ার আয়োজনে আইসিটি বিষয়ক এক সেমিনারে তিনি মোবাইল, ইন্টারনেট এবং ই-কমার্সের উপর এক দীর্ঘ বক্তব্য দেন। আমি তখন তাঁর ইন্সটিটিউটে ভর্তি হলেও (না বুঝে) মনে মনে হাসলাম এবং বললাম এগুলো তাঁর ব্যবসায়িক ফন্দি, এতো দ্রুত আমাদের দেশে মোবাইল, ইন্টারনেট বা ই-কমার্সের প্রসার ঘটবে তা কল্পনা করাও ভুল হবে। কিন্তু ভুল আমরাই প্রমাণিত হলাম। কারণ তিনি যে এক যুগ সময়ের কথা বলেছিলেন তার আগেই বাংলাদেশে এগুলোর ব্যাপক প্রচার ঘটে।
সম্প্রচার মাধ্যম খাতটি শুধু বিনোদনই নয়, দেশের গণমানুষের তথ্যপ্রাপ্তি, মতামত প্রকাশ, জনমত গঠন, সংস্কৃতি ও মনন, দেশের ভাবমূর্তি, উন্নয়ন, সুশাসন, গণতন্ত্রায়ন সবকিছুর সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। কাজেই এ খাতে শৃঙ্খলা ও দায়বদ্ধতা এবং এর বিকাশ নিশ্চিত করা জরুরি।
আশার কথা হল গত ২৬ আগস্ট ২০১৪ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন ‘আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সম্প্রচার আইনের খসড়া তৈরী করার জন্য ‘অংশীজন’ নিয়ে কমিটি গঠন করা হবে।’ আমরাও চাই একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে সাংবাদিকদের সব মতের প্রতিনিধিদের নিয়ে আগে একটি প্রকৃত স্বাধীন কমিশন গঠন করা হোক। এ কমিশনই সম্প্রচার নীতিমালা কী হবে তা ঠিক করবে। তার আগে এ ধরনের নীতিমালা সাংবাদিক সমাজের কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়, গণতন্ত্রের জন্যও সুখকর নয়।
লেখক: সাহিত্যিক ও কলামিস্ট, সিলেট।

যোগাযোগ

Editor:Sahadul Suhed, News Editor:Loukman Hossain E-mail: news.spainbangla@gmail.com