Latest News

গল্প : সুরমা পারের লাশ

নেছার আহমদ জামাল

বিষয়টার একটা সুরাহা করা দরকার বলে চিন্তা করলো সুমন। এই সাতসকালে এতো চিল্লাচিল্লি কার ভাল্লাগে? রাতে রুমে আসতে আসতেই বারোটা বাজে। তারপর খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাবে, কিন্তু না মিন্টু আর মিছবা ভাই ধরলো তাস খেলতে। তারপর সিগারেট ধরিয়ে জড়োসড়ো হয়ে খাটের এক কোণে খেলতে বসে। রাত তিনটা কেমনে যে বাজলো তা কেউ খেয়ালই করলো না। পরে যখন চির কুমার কমিটির চেয়ারম্যান এই মেসের প্রধান মিছবা ভাই বললেন কাল আমার অফিস আছে এখন ঘুমাও, তখন ঘুমাতে গেল। কিন্তু ঘুমাতে কমপক্ষে আরো আধ ঘণ্টা দেরী। কারণ বাথরুমের সিরিয়েল। তারপর আবার গার্লফ্রেন্ডের এসএমএসের উত্তর দিয়ে ঘুমাতে হয়। এরপর সাতসকালেই যদি ঘুম থেকে উঠতে হয় তাহলে চলে কিভাবে? এটা নিয়ে আজই চেয়ারম্যানের সাথে আলাপ করতে হবে। মোবাইলে টাইম দেখে বাথরুমে যায় সুমন। ফিরে এসে ভাবে বের হয়ে দেখবে কি-না কী নিয়ে এত চিল্লাচিল্লি হচ্ছে। তারপর ভাবে কী হবে বের হয়ে, এই জরিনার মা’র পুরনো কাসুন্দিই হবে। কেইসটা মেসের পিয়াজ চুরি। থাক্ তারচেয়ে বরং একটা সিগারেট ফুকে আবার ঘুমানো যাক্। খাটের পাশে রাখা বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি খায়। তারপর সিগারেট ধরায়। ঘুমরাজ্যে খড়া পড়েছে। কিছু করার নেই। নিদ্রাদেবী বোধহয় বেড়াতে গেছে তাই তার আর ঘুম আসবে না। আস্তে আস্তে পত্রিকার কাগজ দিয়ে জোড়া দেওয়া ভাঙ্গা জানালার একটা পাট খুলে। রিকশার টুংটাং শব্দ আসে। রাস্তায় ব্যস্ততা আস্তে আস্তে বাড়ছে। সুমন উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রাস্তার দিকে। চারতলার জানালা দিয়ে তাকালেই মেইন রোড এবং তার পাশের বিদ্যালয়ের গেটটা দেখা যায়। সে তাকিয়ে দেখে হন্ হন্ করে ছুটে চলা মানুষ নামের যন্ত্রগুলোকে। কারো কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ করার সময় নেই। মানুষগুলো যেন এক একটা মেশিন। কিন্তু তারপরেও এই মফস্বল শহরের মানুষগুলো রাজধানী ঢাকা শহরের মানুষগুলো থেকে ভালো। এখনো রাস্তা-ঘাটে একটা হাক-ডাক পড়লে মানুষ দৌড়ে আসে; একত্রিত হয়, সাহায্যের হাত বাড়ায়। কিন্তু মতিঝিলের ঘটনা তো তার নিজের দেখা। ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়েছে শতশত গাড়ী। এক রিক্সারোহী মহিলার গলা থেকে চেইন ছিনতাই করে নিয়ে হেটে হেটে যাচ্ছিল ছিনতাইকারী। মহিলা চিৎকার করলেও একটা লোকও এগিয়ে এলো ন্।া আর যাই হোক এদিক দিয়ে সিলেট এখনো ভালো। আর যদি পুরান পুলের উপর ওঠে এক সাথে ২/৩ জন লোক নিচের দিকে তাকায় তাহলেই সারছে। এখন সবাই তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করবে কী হয়েছে ভাই? কী হয়েছে? এই সাত সকালেও জরিনার মা’র চেচামেচি শুনে নিশ্চয় আশ-পাশের কিছু লোক জড়ো হয়ে গেছে। তারপর সবাই স্বপ্রণোদিত হয়ে রায় দিচ্ছে- না মেসের বর্ডারদের এটা করা হয়নি, ওঠা করা হয়নি। জরিনার মাও কিছুক্ষণ গ্যানর গ্যানর করে এক সময় রান্না-বান্না করবে। ঘণ্টা দু’য়েকের ভিতর এটা সবাই ভুলে যাবে। এরপর মনে হবে এখানে কিছুই ঘটেনি। গত সাত বছরে এগুলোর সাথে সে অভ্যস্থ হয়ে গেছে।
তার ভাবনাতে ছেদ পড়ে রুবেল ভাইর গলা খাকড়ানির শব্দ পেয়ে। রুবেল ভাই এ মেসের মধ্যে সবার আগে ঘুম থেকে ওঠেন উনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য। তিনি এখানে থাকার লোক না তারপরও থাকেন। এরপর ওঠবেন আর্কিটেক্টার আনোয়ার। তারপর আস্তে আস্তে সবাই যার যার কাজে বেরিয়ে গেলে পরে ওঠবে সুমন। তারপর তাড়াহুড়া করে কিছু না খেয়ে অফিসে যাবে লেট করে। একদিকে পেটে ক্ষুধা অন্যদিকে বসের বকুনি খাওয়ার ভয় এই নিয়েই অফিসে ঢুকেই বসের সাথে দেখা হবে। টেনেটুনে একটা হাসি দিয়ে সালাম দিবে। তাতেও বসের মন গলবেনা, দু’একটা কথাও বলবেন। এরপর অফিসের বয়কে দিয়ে খিচুড়ি এনে নাস্তা করবে দুপুর- ১২ বা ১ টায়। এটা তার নিয়ম হয়ে গেছে। আজ খুব সকাল ঘুম থেকে ওঠেছে এখনো ঘুমায়নি তাই তার মেজাজ খারাপ। ভাবছে অফিস কামাই দেবে। কিন্তু সারাদিন বাসায় করবে টা কী? অবশ্য একটা কাজ তার আছে সেটা হচ্ছে মোবাইল। মোবাইল দিয়ে দিন পার করা তার জন্য কোন ব্যাপারই না। আগে ছিল নকিয়া ৩৩১০ মডেলের মোবাইল। এখন আর ওসব চলেনা। এখন বড় স্ক্রীনে ফেইসবুক চালানোর জন্য স্মার্ট ফোন নিয়েছে। মনে হয় লন্ডন থেকে ফজর আলী চাচা দিয়েছেন। ইদানিং সে ফেইসবুকে কাব্যচর্চা করে। শুধু তাই নয় ফেইসবুকের স্ট্যাটাস দিয়ে একটা বইও বের করেছে। জুকারবার্গের কাছে থেকে জানা যেতে পারে স্ট্যাটাস দিয়ে বই এটাই প্রথম কোন ইউজারের কি-না। সুমন তার দুই হাজারের বেশি বন্ধুদের উদ্দেশ্যে স্ট্যাটাস দিলো ‘আজ ক্লিকবাজিতে যাচ্ছি না।’ সে পেশায় একজন ক্লিকার। ক্যামেরার পেছনেই তার কাজ। সে সিদ্ধান্ত নিল আজ ২টা পর্যন্ত ঘুমাবে। তারপর ফ্রেস হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে, বিকেলে ক্বীন ব্রিজের নিচে যাবে। সেখানে পত্রিকা বিছিয়ে বাদাম আর ঝাল মুড়ি খেয়ে বন্ধু-বান্ধব সবাই মিলে বাউল গান গাইবে।
হঠাৎ তার বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠলো। আজ কেন তার প্রিয়জনদের কথা খুব মনে পড়ছে? কফি হাউজের আড্ডার মত আসলেই তো তার জীবন। সুহাদ প্যারিসে, অঞ্জন ঢাকাতে, পরিবেশবাদী রাজা চলে গেল না ফেরার দেশে। মাছুম এখন বড় ব্যাবসায়ী, মকবুল ভাই শিক্ষক, বাংলা কাগজের সুহেদ ভাই স্পেনে, শিহাব ভাই লন্ডনে আর আলীম শাহ্ টিভি ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছে। সাংবাদিক সজল ছত্রী ব্যস্ত পত্রিকা নিয়ে আর দেবু দা গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার নূরুল সৌদি আরবে ব্যবসা করছে। রাত তিনটায় মশরাফিয়া রেস্টুরেন্টে যে ছায়েদ নিয়ে যেত চা খেতে সে এখন ইতালীর পালেরমোতে। তাহলে কে আসবে আজকের আড্ডায়? হয়তো জসিম, আনোয়ার, ছালেহ ভাই আর তাজ মামা বা আরো দু’একজন আসবে। ড্যান্সিং সার্কেলের কাছে কিছুক্ষণ বসবে। তাজ মামা ‘মোবাইল ফুড সার্ভিস’ এর পরিবর্তে তার নতুন প্রজেক্ট ‘বিউটিফুল সিলেট’ নিয়ে কথা বলবে। ছালেহ ভাই তার ওকালতির স্বভাব অনুযায়ী জেরা শুরু করবে। আকবর ভাই শফিক ভাই থাকবে সঞ্চালকের ভূমিকায়। নাহিদ হিসেব দিবে ক’জন লোক স্টুডেন্ট ভিসায় বিদেশ গেছে। ক’দিন পর দেখবে এদেরও অনেকেই নেই। শুধু সে-ই রাবারের মানুষের মত রয়ে গেছে। যাই হোক সে আজ আড্ডায় যাবেই। তার প্রিয় মিতালী ২/১৩ নম্বর রুমের ভাঙ্গা খাটের উপর শুয়ে শুয়ে সিগারেটে সুখটান দিয়ে একে একে সবাইকে ফোনে দাওয়াত দেয়। মনে মনে ভাবে আজ তার আনন্দের দিন। ঠিক সেই মুহুর্তেই তার দরজায় টুক টুক শব্দ হল। লাইট না জ্বালিয়েই দরজা খুলল। জরিনার মা দাঁড়িয়ে। কী হয়েছে খালা? সুমন জানতে চাইলো। ওমনিতে জরিনার মা কান্নাকাটি শুরু করে দিল। সুমন কিছুটা ভ্যাবাছেকা খেয়ে গেলো। আবারো জানতে চাইলো খালা কী হয়েছে? জরিনার মা একবার কথা বলে তো তিনবার কাঁদে। এইভাবে তিনি বললেন- আমার একমাত্র নাতনিকে পাঁচ বছরের রেখে মারা যায় তার মা জরিনা। এই পাঁচ বছরের নাতনিকে পনেরো বছর পর্যন্ত আমিই কোলেপিঠে মানুষ করেছি। আমার জীবনের সব উপার্জন নাতনির পেছনেই ব্যয় করেছি। এই নাতনিকে বিয়ে দিয়েছি প্রায় ছয় মাস। নাতিন জামাই কৃষিকাজ করে। গতকাল বিকেলে বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছে। কেন নিয়ে গেছে কেউ সঠিক বলতে পারে না। কেউ কেউ বলে জামাত শিবির বলে ধরেছে। বাবা জামাত কী? এখন আমি কী করব? আমার পৃথিবী অন্ধকার। আমার জোয়ান নাতনি। আমি যে রুমের রান্না করি তারা বলেছে কেউ কিছু করতে পারবে না। এখন বাবা তুমি তো সাংবাদিক, তোমার ছবি পত্রিকায় ছাপা হয় তুমি আমার নাতিন জামাইকে বাঁচানোর একটা ব্যবস্থা কর।
সুমন মনে মনে ভাবে সকালে যা ভাবছিলাম কাহীনি তার উল্টো। কিন্তু সে কী করতে পারে। সে একজন ফটোগ্রাফার মাত্র। মাঝে মাঝে তার দু’য়েকটা ছবি পত্রিকায় ছাপা হয় এর চেয়ে বেশি তো নয়। তবু সে তার পরিচিতি দু’ একজনকে ঘটনাটা বলে করণীয় জানতে চায়। তারা বলেন দেখি কী করা যায়। সে গোসল খাওয়া-দাওয়া না করেই অসহায় বৃদ্ধা ও তার নাতনিকে বাঁচানোর জন্য বেরিয়ে যায় বিশ্বম্ভপুর থানার উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যার পর তার বন্ধুরা সুরমার তীরে ক্বীন ব্রিজের নিচে আড্ডা দেয়, স্থানীয় সমস্যা, রাজনীতি, ক্রিকেট আর ফেইসবুকে ট্যাগ করা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলে। ছালেহ ভাই সুরমা নদীতে নৌকা ভ্রমণের আয়োজন করে, শুধু সুমন নেই। সুমনের মোবাইলে ফোন দিলে বন্ধ পাওয়া যায়। সেদিন সন্ধ্যায় সুরমা পাড়ে সূর্য অস্ত যায় পরদিন সকালে আবার ঠিকই সূর্য উঠে কিন্তু সুমন আর ফিরে আসে না।
দু’দিন পর কাজির বাজার এলাকায় সুরমার তীরে একটি অজ্ঞাত লাশের সন্ধান পাওয়া যায়। সুমনের মা এসে চিহ্নিত করেন এটা তার কলিজার টুকরা।

যোগাযোগ

Editor:Sahadul Suhed, News Editor:Loukman Hossain E-mail: news.spainbangla@gmail.com