Latest News

বাউল : দেহতত্ত্বের সাধনাই যাদের মূল

নেছার আহমদ জামাল
বাউল কী : বাউল শব্দের অর্থ ও উৎপত্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি মতামত আছে। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান-এ বাউল শব্দের অর্থ বলা হয়েছে- ধর্ম বা সাধক সম্প্রদায়বিশেষ, একটি গায়ক সম্প্রদায়, সঙ্গীতের সুর বিশেষ। আরো বলা হয়েছে বাউল শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত বৌদ্ধ তান্ত্রিক বজ্রীকুল থেকে বজ্জীউল, বজ্জীউল থেকে বাজুল, বাজুল থেকে বাউল। বাউলের আরেক অর্থ পাগল বা ক্ষ্যাপা। অভিধানে বাউল-এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে- Wandering minstrel; bard; singer of religious songs, religious enthusiast. ইংরেজিতে Minstrel অর্থ (মূলত) চিত্তবিনোদনার্থ পেশাদার আমোদ-প্রমোদ প্রদর্শক, মধ্যযুগীয় ইউরোপে যে বীণাবাদক নিজের বা পরের কবিতা গেয়ে বা আবৃত্তি করে বেড়াত। অনেকে বাউলের অনেক রকম অর্থ দিয়েছেন। সংস্কৃত “ব্যাকুল” বা “বাতুল” শব্দের মূল [সং. ব্যাকুল বা বাতুল>বাউল]। এর অর্থ উন্মাদ বা পাগল। আবার কেউ চর্যাগীত ও অবহট্ট রচনায় ব্যবহৃত বাজিল, বাজ্জিল, বাজুল শব্দগুলোকে বাউল শব্দের আদিরূপ বলে থাকেন।
আবার কেউ কেউ মনে করেন- ‘বা’ শব্দের সঙ্গে ‘উল’ শব্দ যোগে বাউল শব্দ গঠিত। বা+উল মিলে হলো বাউল। ‘বা’ অর্থ বাতাস আর ‘উল’ শব্দের অর্থ অনুসন্ধান করা। বাউল মানে যারা বাতাসের অনুসন্ধানী। অর্থাৎ এই দেহে বাতাসরূপী যে প্রাণবায়ু খেলা করে সেই মনের মানুষের সন্ধানই বাউলের করণকার্য। ড. আহমদ শরীফ বলেছেন, কারোর কারোর মতে ‘বায়ু’ শব্দের সাথে ‘ল’ যুক্ত হয়ে, বায়ুভোজী উন্মাদ কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসক্রিয়ার দ্বারা সাধনাকারী অর্থে বাউল শব্দ তৈরি হয়েছে।
বাউল শব্দটির উৎস সম্পর্কে ডক্টর আনোয়ারুল করিম তার বাংলাদেশের বাউল বইতে লিখেছেন, প্রাচীন প্যালেস্টাইন-এর রাসসামরায় বা’আল নামের একজন প্রজননদেবতার উপাসনা করা হতো। এই দেবতার বা’আল নামটি লোকনিরুক্তি অনুসারে বা’আল>বাওল>বাউল এভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। মোট কথা বাউল শব্দটি প্রাচীনকালে যে অর্থেই ব্যবহৃত হোক-না কেন বর্তমানে এই শব্দটি দ্বারা এক বিশেষ ভাবুক সম্প্রদায়কেই বোঝায়।
বাউল কারা : বাউল বলতে সাধারণত আমরা কী বুঝি? বাউল বলতে আমরা সাধারণত বুঝি লম্বা চুল, দাড়ি, গোঁফ, লম্বা আলখেল্লা পরিহিত সমাজ-সংসারের প্রতি অনাগ্রহী আত্মভোলা টাইপের গ্রাম্য অশিক্ষিত বা কম শিক্ষিত লোক, যে একতারা বা দু’তারা হাতে ভাবের গান গায়। কিন্তু সচরাচর আমরা যাদেরকে বাউল বলি বা মনে করি এদের অনেকেই আসলে বাউল নয়। এদেরকে লোকগীতিকার বা লোককবি বা মরমী কবি বলা যেতে পারে। এরা লোকসাহিত্য বা মরমী সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন বটে তবে তারা বাউল নয়। অনেকেই বাউল, লোককবি এবং মরমী কবিকে এক করে ফেলেন। বিষয়টি খোলাসা করার জন্য লোকসাহিত্য, মরমীসাহিত্য এবং বাউল সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক।
লোকসাহিত্য : নৃতাত্ত্বিকভাবে লোকবিজ্ঞানীরা স্বীকার করেন যে, পৃথিবীতে মানুষের আগমনকাল থেকে শুরু করে হাজার হাজার বছর পর্যন্ত বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা, ভিন্ন চিন্তাচেতনা, ধর্ম-বিশ্বাস ও সংস্কৃতির কারণে আদিকাল থেকেই একেক মানুষের চিন্তা একেক রকম, যা জন্ম দিয়েছে একেকটি সভ্যতা ও সংস্কৃতির। এ ভিন্নতার সংমিশ্রণ-মিলন এবং বিরহের কারণে মানুষের মনে বোনা সুর লোকমুখের ভাষায় রচিত হয়েছে। এক যুগে রচিত হয়ে অন্য যুগে এসে এর সংস্কার সাধন হয়েছে। ইহাকেই বলা হয় লোকসাহিত্য।
মরমী সাহিত্য : ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের গোড়া থেকে পীর আউলিয়াদের দ্বারা যখন বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল প্রভাবিত হচ্ছিল তখন থেকে সাধক ফকিরদের চেষ্টা-প্রচেষ্টার ফলে মানুষকে শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে রচিত হয় পুঁথি পুস্তক, রাগ ও মরমী সঙ্গীত। যার প্রধান বিষয়বস্তু খোদা প্রেম, নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, ইসলামী ইতিহাস, ঐতিহ্য, কাহিনি ইত্যাদি। এরপর পীর আউলিয়াদের নির্জন সাধনায় আধ্যাত্মিক ওয়াজ নসিয়ত সমুহ মানুষের হৃদয়ে যে আবেগের সৃষ্টি করেছে তা ছন্দোবদ্ধ স্তবকে প্রকাশ হয়েছে। পরে এগুলোই মুর্শিদী বা ফকিরালী গান বা মরমী সঙ্গীত বা মরমী সাহিত্য নামে খ্যাত হয়।
বাউল : খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে অনেক উপসম্প্রদায় গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া-পাবনা এলাকা থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম-বোলপুর-জয়দেবকেন্দুলি পর্যন্ত এলাকার মধ্যে তান্ত্রিক কর্তাভজা সম্প্রদায়ভুক্ত সহজিয়া উপসম্প্রদায় ও ইসলামি সুফি দর্শনে প্রভাবিত হয়ে বাংলায় বাউল নামে আধ্যাত্মবাদী চারণকবি রকমের একটি নতুন সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে। এরাই বাউল নামে পরিচিত।
এবার আমরা ফিরে আসি বাউল কারা এই প্রশ্নে। খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে থেকে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায় সর্ম্পকে প্রায় সোয়শ’ বছর আগে অক্ষয় কুমার দত্ত বা এইচ. এইচ. উইলসন ধারণা দিয়ে গেছেন। এরপর মধ্যখানে দীর্ঘ দিন এ বিষয়ে আর তেমন কাজ হয়নি। গত প্রায় দু ইবা তিন দশক ধরে বেশ কিছু কাজ হয়েছে। বাউলতত্ত্ব, বাউল সম্প্রদায়, বাউল গান এবং বাউলগুরু লালন বিষয়ে প্রায় দু’শ বই বেরিয়েছে। বেরিয়েছে আরো অনেক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গান, কবিতা, নাটক ও চলচ্চিত্র। এই বিষয়গুলোতে অনেক লেখকের একাধিক বইও রয়েছে। এদের মধ্যে- ১. বসন্তকুমার পাল- মহাত্মা লালন ফকির। ২. ক্ষিতিমোহন সেন- বাংলার বাউল। ৩. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য- বাংলার বাউল ও বাউল গান, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানী, কলকাতা। ৪. আহমদ হোসাইন- বাউল-তত্ত্ব। ৫. ইন্দিরা দেবী- বাংলার সাধক বাউল। ৬. ড. আনোয়ারুল করীম- বাউল কবি লালন শাহ, পারিজাত প্রকাশনী। ৭. সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়- বাংলার বাউল: কাব্য ও দর্শন। ৮. মুহম্মদ আবু তালিব- লালন শাহ ও লালনগীতিকা, ১ম খ-; ২য় খ-, বাংলা একাডেমি। ৯. ড. আনোয়ারুল করীম- বাউল সাহিত্য ও বাউল গান, পারিজাত প্রকাশনী। ১০. এ.এইচ.এম. ইমামউদ্দীন- বাউল মতবাদ ও ইসলাম। ১১. খোন্দকার রিয়াজুল হক- লালন শাহের পূণ্যভূমি: হরিশপুর। ১২. ড. আহমদ শরীফ- বাউলতত্ত্ব, বাংলা একাডেমি। ১৩. ফরহাদ মজহার- সাঁইজীর দৈন্য গান, চিন্তা প্রকাশনা, ঢাকা। ১৪. সুধীর চক্রবর্তী- গভীর নির্জন পথে, আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা। ১৫. আবুল আহসান চৌধুরী- কুষ্টিয়ার বাউলসাধক। ১৬. অহহ-ঐবষবহব ঞৎড়ঃঃরবৎ- ঋধশরৎ (খধ ছঁবঃব ফ’ঁহ ইধঁষ গঁংঁষসধহ) খ’ঐধৎসধঃঃধহ, চধৎরং, ঋৎধহপব. ১৭. সুবোধ চক্রবর্তী- বাঙলার বাউল লালন ফকির, আদিত্য প্রকাশনালয়, কলকাতা। ১৮. খোন্দকার রিয়াজুল হক সম্পাদিত- লালন সাহিত্য ও দর্শন, মুক্তধারা, ঢাকা। ১৯. অন্নদাশঙ্কর রায়- লালন ও তার গান, শৈব্যা পুস্তকালয়, কলকাতা। ২০. মনিরউজ্জামান- লালনজীবনী ও সমস্যা; ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগেই যা বলা হয়েছে কিংবা আমরা বাউলদের জীবনাচার বিশ্লেষণ করলে দেখি- বাউল বলতে অতি নিরীহ, শান্ত, সংযত, সর্বদা আত্মগোপনশীল, সাংসারিক ভোগবিলাসে উদাসীন, ভাবের ঘোরে আত্মসম্মোহিত ও অন্যমনস্ক এক সম্প্রদায়; যারা প্রবল দারিদ্রতা ও  নানা সামাজিক নির্যাতন সহ্য করেও নীরবে স্থির বিশ্বাসে আপন ধর্ম সাধনা করে তাদেরকে বাউল বলা হয়। তাদেরকে পাগলও বলা হয়। কারণ এদের আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, পোশাক-পরিচ্ছদ সবই প্রচলিত সামাজিক রূপ থেকে আলাদা। এরা কোন দেব-দেবী, পূজা-আচার, নামাজ- রোজা, মসজিদ-মন্দির মানেন না। কাজেই এরা থাকেন বা থাকতে ভালবাসেন সর্বজন গৃহীত জীবন ধারার বাইরে। এজন্যই এদের আরেক নাম ক্ষ্যাপা। বাউলরা ঘুরে ঘুরে তাঁদের চিরন্তন অন্তর্যামী সত্ত্বা ‘মনের মানুষ’ এর গান গেয়ে থাকেন এবং ধর্মে ধর্মে অযৌক্তিক ভেদাভেদের কথা তুলে ধরেন। বাউল কোন সমাজচ্যুত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়। বাউল আমাদের সমাজেরই একটি স্বতন্ত্র ভাবুক সম্প্রদায়ের নাম। যারা বাউল হন তারা গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে সাধনা করেন। এর কোন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেই বিধায় এখানে শিক্ষিত হতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
সমাজবিজ্ঞান ও লোকধর্মে পি.এইচ.ডি. সম্পন্নকরেও সুধীর চক্রবর্তী বলতে গেলে তার জীবনটাই কাটিয়ে দিয়েছেন বাউল বা এইসব উপসম্প্রদায় নিয়ে গবেষণা করে। প্রায় বিশ বছর নদীয়া-মুর্শিদাবাদ-বীরভূম-বর্ধমান আর বাংলাদেশের নানা গ্রাম ঘুরে বেরিয়েছেন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে তার ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড থেকে বের হয় তার প্রথম বই গভীর নির্জন পথে। বাউল সম্প্রদায়ের লোকদেরকে পাগল, ক্ষ্যাপা বা উন্মাদ ভাবা হলেও এরা যথেষ্ট প্রাজ্ঞ। এরা শিক্ষিত না হলেও সমাজে প্রচলিত সকল ধর্ম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন এবং তাদের ভাষা বুঝা যে কঠিন তা তার উক্ত বই থেকে পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন- ‘সবচেয়ে বেকুব বনতে হত গানের আসরে। হয়ত মচ্চব শেষে সারা রাত চলল গানের আসর। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ বসে সে গান শুনছে মৌজ করে, গায়ক গাইছে প্রাণ খুলে। আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ তকমাধারী, অথচ সে গানের বিন্দুবিসর্গ বুঝছি না।’ আসলেও তাই। শুধু একাডেমিক শিক্ষার সার্টিফিকেটধারী হলেই এগুলো বুঝা সম্ভব নয়। বাউলদের গান বুঝতে হলে আগে তাদের পরিভাষা বুঝতে হবে, না হয় অধিকাংশ কথা বুঝা সম্ভব নয়। যেমন- অমাবস্যা মানে নারীর ঋতুকাল, বাঁকানদী মানে স্ত্রী যোনী, কুমীর মানে কাম, লতা মানে সন্তান, চন্দ্রসাধন মানে মল মূত্র পান, খাকি মানে মাটি।
অনেকে বাউলদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অবাধ যৌনাচারের কথা বললেও সুধীর চক্রবর্তীর কাছে গোট পল্লীর আর্জান শানু বলছেন- ‘নিজের শরীরের বস্তু কি ঘেন্নার জিনিস? বস্তু রক্ষা করা আমাদের ধর্ম, শুক্ররক্ষা। অযথা শুক্রক্ষয় আর সন্তানজন্ম মানে আপ্তমরণ, নিজেকেই মারা। ... তাই বলে নারী আমাদের ত্যক্ত নয়। নারীকে নিয়েই আমাদের সাধনা। বিন্দু সাধন। যাকে বলে রসের ভিয়ান। দুধ জ্বাল দিয়ে দিয়ে যেমন ক্ষীর তেমনই। আর ওথলায় না। কামকে তেমনই পাকে চড়িয়ে শান্ত করতে হবে।’ (গভীর নির্জন পথে, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা: ১৪)
এখানে ‘নিজের শরীরের বস্তু কি ঘেন্নার জিনিস’ দ্বারা তারা যে মল মূত্র ভক্ষণে অভ্যস্থ সে কথারই প্রমাণ মিলছে।  তবে তাদের মতে রজঃ, বীর্য ও রসের কারণেই এ দেহের সৃষ্টি। তাই এগুলোকে বাঁচিয়ে দেহ সাধনা করতে হবে। আর এগুলো বাঁচানো মানে হল এগুলো ব্যয় করার উপযুক্ত ব্যবস্থা বা সুযোগ থাকা সত্তেও ব্যয় না করা। এক্ষেত্রে ড. আহমদ শরীফের বর্ণনা হচ্ছে- কামাচার বা মিথুনাত্বক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। বাউল সাধনায় পরকীয়া প্রেম এবং গাঁজা সেবন প্রচলিত। বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরী হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারণ ঘটনা। এছাড়া, তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে। (বাউলতত্ত্ব, পৃষ্ঠা ৩৫০)
ডক্টর আনোয়ারুল করিম এ বিষয়ে তার বাংলাদেশের বাউল বইতে প্রায় একই মত পোষণ করেছেন। তিনি লিখেছেন- প্রাচীন প্যালেস্টাইন এর রাসসামরায় বা’আল নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। তৌরাত, ইঞ্জিল (বাইবেল), কোরান মজিদসহ সকল ধর্মগ্রন্থেই এই দেবতাকে তীব্র নিন্দা করা হয়েছে এবং তার উপাসনা থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলত বা’আল প্রজনন-দেবতা হওয়ায় মৈথুন বা যৌনাচার এই ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। (বা.বা পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫)। সাধারণ জনারণ্যে বাউলরা নাড়ার ফকির নামেও পরিচিত। ‘নাড়া’ শব্দটির অর্থ হল শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোন সন্তান হয়না।
বাউলদের ধর্ম: বাউলদের ধর্মও স্বতন্ত্র। এই ধর্মপালনকারীদের বৈশিষ্ট্যগুলোও সাধারণদের থেকে আলাদা। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনকিছু বলেই পরিচয় দেয়না। বাউল সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ডক্টর আনোয়ারুল করিম বলেন- ‘বা’আল ধর্ম একসময় এ উপমহাদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সূফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোকধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগনির্ভর দেহজ সাধনা। কালক্রমে এই বা’আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে।’ (বা.বা পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫।)
লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার ‘ওরসে’ তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ্। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি। আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরান তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ।’’ (দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃষ্ঠা ৪-৯৫)। তারা যেমন হিন্দুধর্মের গলদ বের করে সংস্কারে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন, তেমনি মুসলিম ধর্মের বিরুদ্ধেও সমালোচনার খড়গ তুলে ধরেন। এই মতবাদ কোনমতেই হিন্দু বা মুসলিমধর্মের উপধর্ম নয়। এটি এই দুই ধর্মের বাহিরে এক স্বতন্ত্র ধর্মমত।
অনেকে বাউল ও বৈষ্ণবধর্মকে এক মনে করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বৈষ্ণবধর্মের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, হিন্দুধর্মকে সংকট থেকে উত্তরণের জন্য হিন্দুধর্মের নতুন সংস্করণরূপে বৈষ্ণবধর্মের জন্ম। বৈষ্ণবধর্ম কখনোই হিন্দুধর্মকে অস্বীকার করে নি বরং হিন্দুধর্মের আধুনিকায়নে বৈষ্ণবধর্ম সহায়ক রূপে কাজ করে গেছে সর্বকালে সর্বাবস্থায় উপধর্মমতরূপে। শ্রী চৈতন্যদেবের যোগ্য সহচর, সভা পার্ষদ নিত্যানন্দ বৈষ্ণবধর্মের প্রসারে নিজেকে নিবেদন করেন এবং তাঁর হাত ধরে বৈষ্ণবধর্ম উৎকর্ষ লাভ করে। আর তারই পুত্র বীরভদ্র যখন বৈষ্ণবধর্ম ত্যাগ করে বাউলধর্মে দীক্ষিত হন তখন নিত্যানন্দ তাঁর এই অপরাধের জন্য তাকে ত্যাজ্য করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। কেহ কেহ বলেন নিত্যানন্দের ত্যাজ্যপুত্র হয়ে তিনি বীরভূমে গিয়ে থাকতেন। তাই এ কথা যৌক্তিকতার সঙ্গে মেনে নিতে হয় যে, বাউল ও বৈষ্ণব এক জিনিস নয়। তবে এর সঙ্গে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, বাউলদের উপরে বৈষ্ণবদের প্রভাব থাকতে পারে। কারণ মানুষ কখনোই আদল ও আমুল বদলে ফেলতে পারে না। সেটা পরিবর্তনেই হোক আর বিবর্তনেই হোক। তার ওপর কিঞ্চিৎ হলেও উত্তরাধিকারের প্রভাব থাকে। তবে এই প্রভাব বহিরাঙ্গের, মৌলিক কোন প্রভাব নয়। মোটকথা হচ্ছে বাউল ও বৈষ্ণব এক নয়।
ড. আহমদ শরীফ তার বাউলতত্ত্ব বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন- ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপ্নথ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলেন-
কালী কৃষ্ণ গড খোদা
কোন নামে নাহি বাধা
মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।” (বাউলতত্ত্ব, পৃষ্ঠা ৫৩-৫৪)।
এ সম্পর্কে আমাদের আরো পরিস্কার করে গেছেন লালন শিষ্য দুদ্দু শাহ তার গানে-
বাউল বৈষ্ণব ধর্ম এক নহে তো ভাই
বাউল ধর্মের সঙ্গে বৈষ্ণবের যোগ নাই॥
বিশেষ সম্প্রদায় বৈষ্ণব,
পঞ্চতত্ত্বে করে জপতপ
তুলসী মালা অনুষ্ঠান সদাই॥
বাউল মানুষ ভজে
যেখানে নিত্য বিরাজে,
বস্তুর অমৃতে মজে নারী সঙ্গী তাই॥
নিত্যানন্দের দুই পুরুষ হয়,
বীরভদ্র বীর চূড়ামণি কয়,
দুইজন দুই মতের গোসাই
শুনতে পাই॥
এর পরে আর কোনো ভাবেই বাউল বৈষ্ণবকে এক করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা আমাদের অজান্তেই বাউল বৈষ্ণবকে এক করে ফেলি। চলনে বলনে, পোশাকে-আশাকে বাউল বৈষ্ণব আলাদা। বাউলগণ সাদা রঙের আলখেল্লা, পাগড়ি ও সাদা লুঙ্গি পরিধান করে থাকে। আর বৈষ্ণবদের পোশাক গেরুয়া। বাউলদের আচার-বিচার, সাধ্য-সাধনা বৈষ্ণবদের থেকে আলাদা। আধুনিক বৈষ্ণবদের মুখে বাউল গান শুনে বৈষ্ণবকে বাউল বলে ভুল করার সুযোগ নেই।
মরমী বা লোককবিদেরকে বাউল ভাবার কারণ: মরমী কবিরা তাসাউফপন্থী। এশক্, মহববত বা আল্লাহ প্রেমই মরমী সঙ্গীতের বিষয়বস্তু। মুসলিম সূফী সাধকদের ইসলামের বাণী নিয়ে এ দেশে আগমনকাল থেকেই মরমী বা ছামা সঙ্গীত এর প্রচলন হয়। তাই সুলতানী আমলে মরমীবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়। এর বিকাশের শুরু থেকেই মরমী ভাবধারা জনমনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং এই ভাবধারাই অকৃত্রিম সহজাত ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে উঠে। মরমী গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামালের মতে- ‘জগমোহন গোসাঈ বাউল সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। তাকে আদি বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক হিসেবেও গণ্য করা হয়। বৈঞ্চব পদাবলীতে মরমীবাদ সাহিত্যের প্রভাব রয়েছে। বৈঞ্চব পদাবলীর পুর্বরাগ, অনুরাগ, বংশী, বিরহ, সম্মিলন ইত্যাদি শব্দ নামে-উপনামে সূফীবাদ থেকে সরাসরি গ্রহণ করা হয়। এভাবে সূফীবাদকে বৈঞ্চববাদে সংযুক্ত করে একটা ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে।’ আর চৈতন্যবাদ ও জগন্মোহনী ভাবধারার সংমিশ্রণে বাউল মতবাদের জন্ম হওয়ায় এদের অনেক শব্দের সাথে মারফতি বা মরমী গানের শব্দের মিল পাওয়া যায়। ঠিক তেমনি ভাবে লোকসাহিত্যের রচনাগুলোও ঈশ্বর, প্রকৃতি, প্রেম, বিরহ, ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে সহজ ভাষায় রচিত হয় তাই এগুলো মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত থাকে। এদের মধ্যে প্রচলিত গানগুলো যে কেউ গায় বা গাইতে পারে। আর এ গানগুলো সাধারণত গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষজনই গেয়ে থাকে। বাউলরা যেহেতেু গান গায় তাই যে কোন লোকগীতি বা মরমী গান কেউ গাইলে অনেকেই থাকে বাউল বলে ভুল করেন।
অতএব এখন আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, বাউল যেমন আমাদের সমাজেরই একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায়বিশেষ তেমনই তাদের ধর্মও স্বতন্ত্র। যে কেউ বাউল গান গাইলেই বা বাউলের মতো গান বাঁধলেই বাউল হতে পারে না। বাউল হতে হলে সাধনার প্রয়োজন। দেহতাত্ত্বিক সাধনা। আধ্যাত্মিক সাধনা। সত্য-সুপথে চলে মনের মানুষের তালাশ করে বাড়ির পাশের আরশি নগরের পড়শীর সঙ্গে মিলনের সাধনা। যার ভেতর বাউলের দেহতত্ত্বের সাধনা নেই সে যতই আউলা কেশে বাউলা বেশ ধরুক, তাকে বাউল বলা যাবে না।

যোগাযোগ

Editor:Sahadul Suhed, News Editor:Loukman Hossain E-mail: news.spainbangla@gmail.com