Latest News

এক ভুবনের দুই বাসিন্দা : শাহ ইমরান

আইমুন বিবির স্বপ্ন
আইমুন বিবি ৮৯ বছর বয়সের ভারে ন্যুব্জে পড়া জীবনকে মুক্তি দিয়ে পরপারে পাড়ি জমালেন। ৩ দিন পর্যন্ত বেহুশ ছিলেন। মৃত্যুর আগে একবার চোখ খুললেন। ক্ষীণ স্বরে পানি চাইলেন। তার মুখে পানি দেয়া হলো।  চোখ বুজতে বুজতে বললেন, আমার আর খুইল্লে যাওয়া হৈলোনা (আমার আর খুলনা যাওয়া হলনা)। সেটাই তার শেষ কথা ছিল। আইমুন বিবি জন্মেছিলেন খুলনা শহরের দক্ষিনের অঞ্চলে সুন্দরবনের আশপাশের কোনো এক অঁজো গ্রামে। ৯ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি, আর বছরে দুই এক বার বাপের বাড়ি যাওয়া- এই ছিল তার বিশাল দুনিয়া। বিজ্ঞানের বিশাল আবিষ্কারের মধ্যে তার কাছে ঘড়ি আর রেডিও ছিল স্বাভাবিক। কারণ তার বিয়েতে তার বাপজান এই ২ টা জিনিস তার জামাই কে উপহার /যৌতুক হিসেবে দিয়েছিলেন। ঘড়ি আর রেডিও দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন বলে এই ২ আবিষ্কার নিয়ে তার কোনো প্রশ্ন ছিল না। বাকি সব কিছুই তার জন্য ছিল এক বিস্ময়। তার চেনা জানা যত লোক খুলনা শহরে যেত; তারা সবাই তার কাছে ছিল পরম সৌভাগ্যবান মানুষ। তাদের ডেকে ডেকে তিনি শহরের গল্প শুনতেন। কি সব আজগুবি কারবার ঘটে সেখানে! মানুষ নাকি রিকশায় চলে। ৩ টা চাকা আর একটা সিট্।সেই সিটে মানুষ বসে আর এক জন চালায়।  কেমন করে সম্ভব ? তিনি অবাক হয়ে গাড়ির কথা শুনতেন। ৪ চাকার গাড়ি কেমন করে চলে? শহরে ইটের পরে ইট বসিয়ে বিশাল বিশাল ৪/৫ তলা বাড়ি বানিয়ে মানুষ থাকে। এই বাড়ি কেমন করে দাঁড়িয়ে থাকে? আর যারা থাকে তাদের কি ভয় করেনা? যদি ওই বাড়ি ভেঙ্গে পড়ে যায়? বাব্বা শহরের মানুষগুলোর কি সাহস ! সেই শহরে নাকি লাইট জ্বলে ? সেখানে মানুষ নাকি টেমি (কেরোসিনের লেম্প ) জ্বালায় না, কি এক কারেন্টের তার এর ভিতরে কি যেন থাকে। তাই দিয়ে সব চলে।
ফ্যান নামে কি যেন আছে তা নাকি বাতাস দেয়!  টেলিভিশন নামে কি একটা বাক্স আছে তার ভিতরে মানুষ থাকে। নাচে, কথা বলে, কেমন করে সম্ভব ? তার মাথায় ধরতোনা। সেই শহরে তার একবার যেতেই হবে। কিন্তু কেমন করে ? ওখানে যেতে হলে তাকে লঞ্চে করে যেতে হবে। লঞ্চতো আরো বিপদজনক। এতগুলো মানুষ নিয়ে লঞ্চ কেমন করে চলে ? আর ঐটা যদি ডুবে যায়, তাহলে তো তিনি মরেই যাবেন।  না বাবা আমার দরকার নেই খুইল্লে যাওয়ার। গর্বে তার বুক ভরে গেল যখন তার একমাত্র ছেলে ওই শহরের এক মেয়েকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসল। শহরের মেয়ে বলে কথা। তিনি সারা গ্রামে গল্প করে বেড়াতেন শহরের মেয়ে তার বাড়ির বউ। নতুন বউ এর কাছে সারাদিন শহরের গল্প শুনে তার সময় কাটত। তিনি আরো শুনেছেন ওই শহর নাকি অনেক ছোট্ট। ঢাকা নামে আরো নাকি একটা বড় শহর আছে। সেই শহরের গল্প তো তিনি শুনতেই চাইতেন না।  কারণ ওই শহরের কথা শুনলে তার খুলনা শহরটাকে অনেক ছোট্ট লাগে।  তিনি খুলনা কে ছোট্ট ভাবতে পছন্দ করতেন না। এই দুনিয়াটা নাকি অনেক বড় ! অনেক শহর আছে সেখানে। আজব আজব সব কাহিনী ঘটে সেখানে। তিনি ২/১ বার প্লেনও দেখেছেন। এত আরো ভয়ংকর ব্যাপার। কেমন করে তা আকাশে উড়ে? প্লেন দেখলেই তিনি ঘরের ভিতরে দৌড়ে পালাতেন।  যদি তা গায়ের উপরে এসে পড়ে ? সাতটি মেয়ে সন্তান আর একটি ছেলে সন্তান জন্ম দিয়ে সংসার ধর্ম পালন করার পাশাপাশি আইমুন বিবির আর কোনো স্বপ্ন ছিলনা খুলনা শহর দেখা ছাড়া।  সেটাও পূরণ হলনা। বিজ্ঞানের অপূর্ব সৃষ্টি তিনি ছুঁয়ে যেতে পারেননি।  তিনি প্রযুক্তি ভোগ করতে পারলেন না।  লালিত স্বপ্নগুলো অপূর্ণ করেই তিনি মারা গেলেন।

জর্দী মারিয়ান এর স্বপ্ন
৫৬ বছর বয়সের জর্দি মারিয়ান জন্মেছিলেন স্পেন এর আন্দালুসিয়ার একটি ছোট্ট গ্রামে। জীবিকার সন্ধানে ২২ বছর বয়সে তিনি তার গ্রাম ছেড়েছিলেন।  একটি মাল্টি ন্যাশনাল কম্পানির মার্কেটিং বিভাগ এর প্রধান ছিলেন।  আর এই কাজ এর জন্যই তাকে বছরের অধিকাংশ সময়ই দেশের বাইরে থাকতে হত।  তার সাথে আমার কয়েক বার আড্ডা দেবার সুযোগ হয়েছিল।  অল্প পরিচয়ে মানুষকে কাছে টানার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। ব্যাক্তিগত জীবনে অসম্ভব সফল এই মানুষটি পেশাগত কারণে নিজ গ্রামের বাইরে ভিন্ন ভিন্ন শহরে জীবনের বাকি সময় কাটিয়ে গেছেন। তিনি কত দেশ ঘুরেছেন তার হিসাব জানতে চেয়েছিলাম। খুব সাবলীল ভাবে চোখ বুঁজে মুখ উঁচু করা ভঙ্গিতে ঠোঁট উল্টিয়ে বলেছিলেন, ৮৪/ ৮৫ টা হবেতো অবশ্যই।  বিত্ত বৈভব আর আধুনিকতায় পরিপূর্ণ এই মানুষটি (আমাদের দেশের সাবেক এমপি গোলাম মাওলা রনির মত আমেরিকা ভ্রমণের চলমান ৮ পর্বের গল্পের ধারাবাহিকতায় না গিয়ে) সারা বিশ্বের ভ্রমণের গল্প বাদ দিয়ে তার গ্রামের গল্প করতেন।  তার গ্রাম এমন এক জায়গায়, যেখানে এখনো আধুনিকতার পূর্ণ পরশ পায়নি। বিশাল একরের পর একর জুড়ে আঙ্গুর ফলের বাগান। তার মাঝেই গড়ে ওঠা ১৭০ জন বাসিন্দার ছোট্ট গ্রাম।  BAR আছে ঐ গ্রামে মাত্র একটি। যেখানে সবাই কফি, ওয়াইন খেতে গিয়ে আড্ডা মারে। রাত ৯ টা বাজলেই সবাই ঘুমুতে যায়। সেখানে ২ টা মাত্র ছোট্ট মুদি দোকান। সেই গ্রামে সব জায়গায় এখনো মোবাইল এর নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়না। সেই গ্রামের মানুষগুলো কত সহজ সরল জীবন যাপন করতেন- এই বর্ণনা দিতে গিয়ে তার চোখ চিক চিক করত।
 তিনি মোবাইল পছন্দ করতেননা। বাধ্য হয়ে ব্যবহার রতেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রয়োজনীয় অবশ্যই !! এ কথা বিশ্বাস করতেন ; কিন্তু মানুষ দিনে দিনে একদিন রোবটে পরিনত হবে, মানুষ তার স্বকীয়তা হারাবে এমনটি ভাবতেন তিনি। যাইহোক, এক দিনের আড্ডায় (তার সাথে সেটাই আমার শেষ আড্ডা ছিল জানতাম না ) কথায় কথায় আমি জানতে চেয়েছিলাম, জীবনে আর কি পাওয়ার আশা আছে তোর? স্বপ্ন আছে কোনো? তিনি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিলেন।  তার সারা মুখ আনন্দে যেন লাল হয়ে গেল। বললেন,  আমি আমার ছোট্ট গ্রামে ফিরে যেতে চাই। আমি ওই গ্রামের একমাত্র সোনার ছেলে। আমাকে কাছে পেলে ওরা খুব প্রানবন্ত থাকে। ওরা ছাড়া আমার কেও আপন মানুষ নেই। আমি খুব স্বাভাবিক জীবন চাই, আমি আঙ্গুর এর বাগানে কাজ করব, গ্রামের পাশ ঘেসে ছোট্ট খালের কাছে গিয়ে বসে থাকব। আর মহাকাশ নিয়ে কিছু পড়াশোনা করব।  তারপর ? তারপরে কি ? তিনি বললেন, তারপরে কিছু নাই।  আমি আধুনিকতা আর এই শহুরে ফিকে জীবন যাপন থেকে মুক্তি চাই। সে বলল আমি আমার পরিবারকে বলেছি, আমার মৃত্যুর পর আমাকে যেন আমার গ্রামের কবর স্থানেই সমাধিস্ত করা হয়।  আমি আমার শান্তির ঘুমটা আমার ওই গ্রামেই ঘুমাতে চাই।  ( তার আরো অনেক কথা আমি আমার ভাষাগত দুর্বলতার কারণে বুঝতে পারিনি ) তার প্রায় ৭ বা ৮ মাস পরের কথা।  চলন্ত পথে একদিন তার ছেলের সাথে আমার দেখা হলো। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরে জানতে চাইলাম তার বাবার কথা।  খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, গত মাসেই সামান্য ২ দিন এর নিউমোনিয়া জ্বরে  ভোগে তার বাবা মারা গেছেন।  অবাক হলাম নাকি দুঃখ পেলাম বুঝলাম না।  প্রথম প্রশ্নটাই করলাম, সমাধি কোথায় করলি? সে বলল, বার্সেলোনার একটু দূরে। আমার বুকটা মুচড়ে উঠলো।  আহা কেন? গ্রামের বাড়িতে করতে পারলিনা? তার উত্তর ছিল,  আমাদের কারো গ্রামে যাওয়া হয়না। হবেওনা।  তাই এখানেই করলাম।  কি জানি আমার অনেক অভিমান হলো।  আমি ওর কাছে বিদায় না নিয়েই হাঁটতে শুরু করলাম। সারা বিকাল মনটা উদাস হয়ে রইলো এই ভেবে যে, একজন মানুষ তার শেষ স্বপ্নের এতটুকু বাস্তবায়ন পেলনা ?

মানুষের চাওয়াগুলো কত অদ্ভুত, কত ভিন্ন , বাংলাদেশের এক অঁজোপাড়া গাঁয়ের এক আইমুন বিবি ছোট একটি শহর দেখার স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল ; আর উন্নত বিশ্বের একটি দেশের ছোট্ট একটি গ্রামে জন্ম নেয়া জর্দী মারিয়ান বিষন্ন মনে সারা বিশ্ব ঘুরে তার গ্রামে ফিরতে চেয়েছিলেন। খুব জানতে ইচ্ছা করে মানুষ মরে গেলে তার লালিত স্বপ্নগুলোর কি হয় ? তারা কি মৃত ব্যক্তির সাথেই তাদের ইতি রচনা করে? নাকি অপূর্ণ থাকার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে আকাশে বাতাসে অসহ্য যন্ত্রনায়  "আমাকে পূর্ণ কর , আমাকে পূর্ণ কর" বলে চিত্কার করে কাঁদতে থাকে ? কি জানি কি করে।  আমরা বিজ্ঞানের সৃষ্টিতে অভ্যস্ত মানুষরা এই সব ভেবে সময় নষ্ট করিনা। তবুও বলি-  স্বপ্নরা তোমরা বেঁচে থেক, হয়ত কষ্ট নিয়ে বাঁচবে। তবুও বেঁচে থেক।



 
                                                              লেখক: শাহ ইমরান
                                                              সাহিত্যিক, শিল্পী।
                                                                             
বার্সেলোনা,  স্পেন।

যোগাযোগ

Editor:Sahadul Suhed, News Editor:Loukman Hossain E-mail: news.spainbangla@gmail.com