Latest News

গল্প: এলিয়েন ডি থ্রি - নেছার আহমদ জামাল

যান্ত্রিকতায় মোড়ানো এলিয়েন ডি থ্রি’র জীবন। উইন্ডোজের সিস্টেম থার্টি টু এর আদলে ‘প্রজেক্ট থার্টি  টু’ নামক একটা প্রজেক্টের কাজ শেষ করেছে তাদের গ্রুপ। এখন কিছু সময় আছে পরবর্তী প্রজেক্ট শুরুর আগ পর্যন্ত। এলিয়েনদের মধ্যে যুক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিই সব। প্রেম-ভালোবাসা তাদের কাছে বেমানান। কিন্তু তাদের মধ্যে এলিয়েন ডি থ্রি একটু ভিন্ন ধরণের। সে পৃথিবী নামক গ্রহের প্রকৃতি ও মানুষের অনেক খবরা-খবর রাখে। তাই  এবারের ছুটিটা উপভোগ করার জন্য সে পৃথিবী নামক গ্রহের বাংলাদেশ নামক ছোট্ট ভূখণ্ডের  সাত পাহাড়ের মিলন স্থল অপরূপ সুন্দর সিলেটের ‘বিছনাকান্দি’কে নির্বাচন করেছে। অবশ্য বিছনাকান্দি নির্বাচন করার পেছনে আরেকটা কারণ হল কিছু দিন আগে সেখানে নায়িকা পরীমনি শুটিং করে গেছেন। সত্যি সত্যি পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় স্বচ্ছ জলে পরীরা গোসল করতে নামে কি-না সেটা দেখার তার খুব ইচ্ছে। তাছাড়া পাংতুমাই, জাফলং, ভোলাগঞ্জ ও রাতারগুলের মত পযর্টন স্পটগুলো তো কাছাকাছি আছেই, তাই মনের সুখে কয়েকটা দিন ঘুরাঘুরি করা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। অত্যাধুনিক বোয়িং বিমান এক্স জিরো জিরো টু নিয়ে এলিয়েন ডি থ্রি পৃথিবী অভিমুখে রওয়ানা দিল। তাদের এটিসি (এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল) রুম থেকে জানিয়ে দেয়া হল তাকে নিকটবর্তী ওসমানী বিমান বন্দরে নামতে হবে এবং সে জন্য আগে সিভিল এভিয়েশনের পারমিশন নিতে হবে। সে সিভিল এভিয়েশনের সাথে যোগাযোগ করলে তারা জানালো যে, বিমান অবতরণ-উড্ডয়নের জন্য ফি পরিশোধ করতে হবে। এলিয়েন ডি থ্রি সিভিল এভিয়েশনের ওয়েবসাইট ঘেটে দেখল কথা সত্য। তবে বাকীতেও বিমান নামানো-ওঠানো যায়। বাংলাদেশের অনেক এয়ারলাইন্সই বাকীতে বিমান চালাচ্ছে। বাকীর বিষয়টা সার্চ দিলে আরও অনেক মজার মজার তথ্য পায় সে। সাধারণত গরীব লোকেরা ঋণ করে বা বাকী খায়। কিন্তু বাংলাদেশ একটা আজব দেশ যেখানে সাধারণ জনগণের তিন মাসের বেশী বিদ্যুৎ বিল/ গ্যাস বিল/টেলিফোন বিল/পানির বিল বকেয়া হয়ে গেলে লাইনটা কেটে দেওয়া হয়। আর যারা মন্ত্রী-এমপি, শিল্পপতি তারা কোটি কোটি টাকা বাকী রাখলেও লাইন কাটা হয় না। অবশ্য এলিয়েন ডি থ্রি চাইলে সিভিল এভিয়েশনের বিল বাকী রাখতে পারত, কিন্তু তা না করে সে পরিশোধ করে ফেললো। কারণ সেতো মানুষের মত হতে পারে না। এয়ারপোর্টে নেমে সে দ্বিধায় পড়ে গেল যে, এটা কি একটা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট? না কি ফায়ার সার্ভিস স্ট্যাশন? পরে সিভিল এভিয়েশনের কার্যক্রম দেখে কনফার্ম হল যে এটা একটা ইন্টারন্যাশনাল। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বিমান থেকে তার অত্যাধুনিক রোভার কিউ সিক্স মডেলের হাই সিকিউরিটি সমৃদ্ধ ৯.৭৩ এমএম হাই ভ্যালোসিটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নামালো। তারপর ম্যাকস্ক্রিন ফাইভ-এ গুগল থেকে ডাউনলোড করা লোকেশন ম্যাপ দেখে গাড়ি চালাতে শুরু করল।
এয়ারপোর্ট বাইপাসের মুখে এসেই শত শত ট্রাক দেখে এলিয়েন ডি থ্রি থমকে গেল। এটা রাস্তা না-কি ট্রাক স্ট্যান্ড ঠিক ঠাহর করতে পারলনা। আবারও চোখ কচলিয়ে ম্যাপ দেখলো সঠিক রাস্তায় এসেছে কি-না। দেখল ঠিক আছে। এরই মধ্যে একটা সিএনজি চালিত সবুজ অটোরিক্সা চড়ুই পাখির মতো দুই ট্রাকের ফাঁক দিয়ে চলে আসলে সে নিশ্চিত হলো যে এটা রাস্তা। যাইহোক, এরপর সে গাড়িটি নিয়ে আস্তে আস্তে এগুতে লাগলো। কিছু দূর এগিয়ে দেখলো রাস্তায় বিশাল এক গর্ত। রাস্তার এক পাশে গাড়ি রেখে গর্ত থেকে একটু পানি নিয়ে সে তার যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল এখানে জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব আছে। এখন সে টেনশনে পড়ে গেল এই গর্তের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাবে কি-না। কেননা এতে অনেক জলজ প্রাণী মারা যেতে পারে। যদিও এরই মধ্যে একটা ট্রাক চলে গেছে এবং গর্তের কালো পানির ছিটা তার গায়ে এসে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত সে তার রোভার কিউ সিক্স মডেলের গাড়িটি নিয়ে জাম্প দিয়ে গর্ত পেরুলো। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলো রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা টিলায় কয়েকটা শিয়াল একত্র হয়ে কী যেন পরামর্শ করছে। এলিয়েন ডি থ্রি ভেবে পাচ্ছিল না এ ধরণের জনবহুল রাস্তার ধারে সন্ধ্যা রাতে এতগুলো শিয়াল আসার কারণ কী? সে সাথে সাথে  ম্যাকস্ক্রীন ফাইভ অন করে স্যাটেলাইটে তোলা এই জায়গার গত এক সপ্তাহের ছবি ডাউনলোড করে দেখল এখানে একজন মহিলা সন্তান প্রসব করেন। এসব রক্ত/বর্জ্যের কারণে শেয়াল সমাবেশ হয়েছে। সে ভেবে পায়না বাংলাদেশের মানুষগুলো এখনও নিজের জীবন নিয়ে কী রকম ঝুঁকির মধ্যে আছে। অথচ সিলেট বিভাগরেই দশম শ্রেণির এক ছাত্রী জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ভাষণে বলেছে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হার এখন সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে এসেছে। এসব ভেবে তার কোন লাভ নেই। তাই খুবই সাবধানে সে সামনের দিকে এগিয়ে দেখলো রাস্তার মধ্যে প্রায় তিনশ মিটার দীর্ঘ একটা জলাশয়। দুই ধারে পায়ে হাটার জন্য ছোট্ট ভাঙ্গা আইল রকম রাস্তা আছে। এলিয়েন ডি থ্রি বুঝতে পারল না এখন কী করা উচিত। এটা কোন খাল/বিল নাকি রাস্তা তা বুঝার জন্য গাড়ি সাইড করে লেজার রশ্মি দিয়ে জলাশয়ের কিনার থেকে তিন ফুট দূরে পরীক্ষা করে দেখল পানির গভীরতা পাঁচ ফুট। আরেকটু দূরে পরীক্ষা করে দেখল গভীরতা সাত ফুট। সে ভাবলো তাহলে এটা একটা জলাশয় হবে এবং ক্রমান্বয়ে গভীরতা আরো বেশী হবে। ঘড়িতে সময় দেখলো রাত সাড়ে নয়টা।
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। জলের উপর চাঁদের আলোর ঝলকানি অস্বাভাবিক সুন্দর লাগছে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে এলিয়েন ডি থ্রি পানিতে ঝাঁপ দেয়ার প্রস্তুতি নিল। সে তাড়াতাড়ি অক্সিজেন মাস্ক পরে লাইফ সেভার ইন্সট্রুম্যান্ট তার শরীরে ফিট করে মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝাঁপ দিল। এলিয়েন ডি থ্রি যেখানে ঝাঁপ দিয়েছে সেখানে পানির গভীরতা মাত্র তিন ফুট। তাই রাস্তার নিচের বোল্ডারে তার মাথা লাগলেও হ্যাড ক্যাপের কারণে মাথা রক্ষা হয়। কিন্তু প্রচণ্ড ব্যাথায় সে ককিয়ে ওঠে। কোনরকম রাস্তা থেকে উঠে গাড়িতে গিয়ে মাথায় স্প্রে করে। তারপর একটা মার্কার পেন দিয়ে গায়ে ‘নিরাপদ রাস্তা চাই’ লিখে জলাশয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইলো। চতুর্দিকে শোরগোল পড়ে গেল। গভীর রাতেই মিডিয়াকর্মীদের পদচারণায় মুখরিত হল ধূপাগুল প্রাঙ্গন। অনেক চ্যানেলই লাইভ দেখালো এলিয়েন ডি থ্রিকে। পরদিন সকালে পুলিশ এসে জোর করে তাকে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করে। হাসপাতালে একদিন রাখার পর এলিয়েন ডি থ্রিকে রিলিজ দেয়া হল এবং জানানো হল যে, আর যেন কখনও তাকে রাস্তায় প্ল্যাকার্ড হাতে দেখা না যায়। সে বলল আমি তো অন্যায় কিছু করিনি বা বলিনি। আমি যা করেছি বা বলেছি, সবইতো পৃথিবী নামক গ্রহের মানুষের কল্যাণের জন্য। পুলিশ অফিসার শুধু মাথা নাড়লেন এবং বললেন ‘হুম’। এদিকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়ে এলিয়েন ডি থ্রি ধোপাগুলে তার গাড়ীর নিকট আসছে এই খবর মিডিয়া পাড়ায় ছড়িয়ে পড়লে সবাই হুড়মুড় খেয়ে ধোপাগুলে যায়। কিন্তু অনেক অপেক্ষার পরও যখন এলিয়েন ডি থ্রি অসেনি তখন একে একে সবাই চলে গেল। রাস্তার ধারে পড়ে রইলো তার রোভার কিউ সিক্স মডেলের গাড়ি, এয়ারপোর্টে পড়ে রইলো এক্স জিরো জিরো টু বোয়িং বিমান।
কিন্তু এলিয়েন ডি থ্রির আর কোন খবর পাওয়া গেল না।


নেছার আহমদ জামাল
  সাহিত্যিক, সিলেট।

যোগাযোগ

Editor:Sahadul Suhed, News Editor:Loukman Hossain E-mail: news.spainbangla@gmail.com