Latest News

প্রবাসী, তবে...

মহিবুল হাসান খান কয়েশ          
লিখব তবু লিখিনা, বলব বলব করে বলিওনা। কার কাছে বলব? কোথায় লিখব? বলার বা লিখার সময় হাতে সব সময়ই থাকে; তবে লিখাটা পড়ার বা কথাটা শুনার লোক কি আছে?  গরিবের বউকে যেমন সবাই ভাবি ডেকে দিক বেদিক ঠাট্টা মশকরা করে; ঠিক তারচেয়েও বেশি হাসি ঠাট্টা মস্করার উপাত্ত আমরা যারা প্রবাসী তারাই যেন সেজে বসে আছি।  বাবার জমি বিক্রি, ধার দেনা করে কত কঠিন পথ পারি দিয়েইনা আমরা প্রবাসে।  রোদ, ঝড়, বৃষ্টি যাই থাকুকনা কেন, সবার উপরে কাজ।  যেটুকু অসুস্থতায় দেশে থাকতে আমরা লেপ কম্বল কাথা মুড়ি দিয়ে মায়ের কোলে শুয়ে থাকতাম, আর মা কিছুক্ষণ পরপর মাথায় পানি ঢালতেন, তার চেয়ে বেশি অসুস্থতা নিয়েও দিব্যি কাজ করে যেতে হয়। কখনো কখনো শত অসুস্থতার মাঝেও নিজেকে হাসি খুশিতে ভরপুর করে স্বাভাবিক থাকার মিথ্যা অভিনয় চালিয়ে যেতে হয়।
তারপরেও শান্তি।  মাস শেষে কিছুটা সাহায্য আমাদের পরিবারকে আমরা করতে পারি।  প্রবাসে হাতে গুনা কিছু মানুষ ছাড়া প্রায় সবারই নিজের দেহটা আর উপর ওয়ালাই পুঁজি।  সকাল থেকে রাত আবার কেউ কেউ তারচেয়েও বেশি কাজ করে অবসন্ন দেহে ঘরে ফিরে ফিকে হাসি হেসে পরিজনকে কত সুখের বুলি শুনায়।  পরিবার পরিজনের সাথে কথা বলার সময় অনেক ক্ষেত্রেই অনেকে উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে কথা বলে। কিন্তু সেই হাসির পিছনে বুক ফাটা হাহাকার আর নয়নে শ্রাবনধারার জল, তা কি পরিজনেরা দেখতে, শুনতে, বা ঠাহর করতে পারেন?  না পারাটাই বোধকরি ভাল।
প্রবাসে বেশিরভাগ প্রবাসীর সাপ্তাহিক ছুটি একদিন  হয়না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অর্ধেক দিন কাজ করে বাকি অর্ধেক দিন ছুটি পায়। অবাক হবার কিছু নেই যে, কারো কারো সেই অর্ধেক দিন ছুটিও কপালে মিলেনা। কোনো জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কর্মক্ষেত্র ছেড়ে যাওয়া যায় না। এভাবেই দিন থেকে রাত আর রাত থেকে দিন হয়; কিন্তু কাজের কোনো শেষ নেই।  শেষ না হওয়াটাই ভালো। কারণ, কাজ শেষ হলে অন্য কাজ মেলানো কঠিন থেকে মহা কঠিন।  কোনো কারণে কাজ চলে গেলে দেশে টাকা পাঠানো বন্ধ। আর টাকা পাঠানো বন্ধ হলে বাবা মায়ের ঔষধ , বাসা ভাড়া থেকে ছেলে মেয়ের পড়াশুনা সব বন্ধের উপক্রম। তাই কষ্টের দিকে না তাকিয়ে পরিবার পরিজনের মুখের দিকেই প্রবাসীদের দৃষ্টি। আত্মীয় স্বজনের দাবি মিটাতে কতনা মিথ্যা আর ছল চাতুরির আশ্রয় নিয়ে কথা বলতে হয়। কোনো রকমে মাথা গোজার ঠাঁই আর জীবন চলার মত খানা খাদ্য ছাড়া কোনো আনন্দ ফুর্তি জীবনের অংশ- তা প্রবাসীরা ভুলে যায়। মাস শেষে অর্জিত পুরো টাকাটা দেশে পাঠিয়ে বুক ভরা আনন্দ আর তৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফিরে। অর্জিত অর্থ থেকে সঞ্চিত বলতে কিছুই থাকেনা; স্বজনের হাসি খুশি ছাড়া।  এভাবেই চলে প্রবাসীর জীবন। সে জীবন চলতেই থাকে।  আবার যখন থেমে যায়; তখন ঘটে বিপত্তি।
জীবনের অর্জিত অংশের কিছুই যখন অবশিষ্ঠ থাকেনা, তখন যদি জীবন থেমে যায় তাহলে আমাদের নিকট বন্ধু বান্ধব ছাড়াও সকল প্রবাসীদের কাছে হাত পাতেন সাহায্যের জন্য। অতি কষ্টে সকলের সহযোগিতায় টাকা যোগাড়  হলে লাশ দেশে পাঠানো হয়। সারা জীবন সহযোগিতা করে অবশেষে অন্যের সহযোগিতা পেলেই দেশেই মাটি কপালে জুটে; অন্যথায় না।  কোনো কোনো বিবেকবান প্রবাসীর প্রশ্ন থাকে - যে লোক সারা জীবন অর্থ উপার্জন করে রেমিটেন্স দিয়ে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে, সেই লোক মারা গেলে তার জন্য কি বাংলাদেশ সরকারের কোনো দায়িত্ব নেই ? দেশীয় ভাইদের সাহায্যের দিকে তাকিয়ে কেন তাকে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ হিমঘরে পড়ে থাকতে হবে ?  শেষ সময়ে সরকার কি একটিমাত্র দায়িত্ব নিয়ে মরদেহটা পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে পারেনা ?  এই সামান্য খরচে দেশের অগ্রযাত্রা থেমে যাবে বা বেগবান হবে, তা অনুধাবন পূর্বক সুবিবেচনায় আনতে লক্ষ লক্ষ প্রবাসী বাঙালির পক্ষ থেকে কতৃপক্ষের কাছে প্রার্থনা করছি। তবে তা অবশ্যই দাবি নিয়ে।

মহিবুল হাসান খান কয়েশ : কলাম লেখক, বার্সেলোনা, স্পেন।

যোগাযোগ

Editor:Sahadul Suhed, News Editor:Loukman Hossain E-mail: news.spainbangla@gmail.com