Latest News

খণ্ডকথা ১২ : বানানে না পরানে

আজিম খান চৌধুরী :  মাঝে মাঝে দেশ এগিয়ে যাওয়ার খবর শুনে গর্বে বুকটা তিন চার ইঞ্চি ফুলে ওঠে আবার একই খবরের উৎসে যখন কয়েকটা হতাশার খবর দেখি তখন চুপসে যাওয়া বেলুনের মতোই সমস্ত গর্ব খুব দ্রুত চুপসে যায় ৷ আমরাও আশাবাদী ৷ বিদেশী সংস্কৃতি, কথার ফাঁকে বিদেশী শব্দ, ইন্টারনেট, চটকদার বিজ্ঞাপন এসবই কি সব ?
ছাত্র জীবনে ডেমোগ্রাফি পড়তে যেয়ে একটা হাস্যকর তথ্য সংগ্রহের নমুনা দেখে হাসি থামাতে বড়ই কষ্ট হয়েছিল ৷ একসময় পাবলিকের সাবান ক্রয়ের হারও নাকি জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের মাপকাটি হিসাবে ধরা হত ৷ বর্তমানে ইন্টারনেটের ব্যবহারকে যদি উন্নয়নের নেয়ামক হিসেবে কেউ ধরে তাহলে সেটা স্থূল না সুক্ষ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের লক্ষণ তা নির্ণয় করা আমার কাজ না ৷ তবে এতটুকু বলতে পারি ইন্টারনেট একটা জানালার মতো চাইলে সেটাকে কেউ ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারে আবার মন্দ কাজেও ৷ আমাদের পয়সা কড়ি মেগাবাইট গিগাবাইট হয়ে হাওয়ায় হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, সেই খবর খবরই না ৷ কোথায় যাচ্ছে, কার পকেটে যাচ্ছে জানিনা ?
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে একটা দেশ কতটা উন্নত সেটা নির্ভর করছে সেই দেশের মানুষের জীবন যাত্রার মান কতটা উন্নত ৷ কয়েকটা তুলনামূলক তালিকা দেই ৷ অবশ্য তালিকাটা দেয়ার আগে একটা বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া ভাল, সেটা হচ্ছে আমি বিষয়টা নিজের পান্ডিত্ব প্রদর্শনার্থে মোটেও বলছিনা, আমি জানি আমার অভিজ্ঞতা জ্ঞান দুটোরই সাংঘাতিক রকমের ঘাটতি রয়েছে সুতরাং আমার সেই সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রাখতে হয় ৷ এটা সেটা খালি চোখে যা দেখি তা শুধু মাঝে মধ্যে অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করি ৷
যাতায়াত ব্যবস্থার কথা ধরা যাক ৷ আমরা কতটা উন্নত বুঝতে হলে ঢাকায় পাবলিক বাস গুলো কিভাবে মানুষ উঠায়-নামায় আর একই কাজ একটা উন্নত দেশে কিভাবে করে তার তুলনা করতে হবে ৷ উন্নত দেশের অনেক পয়সা ঠিক কিন্তু আমাদের অনেক অনেক জনবল আছে সেটাওতো একটা দিক ৷ ওদের একজনের মাসিক বেতন দিয়ে আমরা বিশ জন কাজ করতে পারবো ৷
আমাদের দেশের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে কি বয়স্ক পঙ্গু মানুষের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে ? মানুষ গুলোকে কি শান্তি মতো বাস ট্রেনথেকে নামতে দেয়া হয় ? হাসপাতাল গুলোর সার্ভিস গুলো একটু তুলনা করেন ৷ প্রসাশনের দিকটা একটু মিলিয়ে দেখুন ৷ খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থান এসবের তুলনা করতে হয় ৷
আমরা শুধু ওদের সংস্কৃতির খারাপ দিকটা আমদানি করতে ব্যাস্ত ভালটা আমদানি করি না, চেষ্টাও করিনা ৷ থার্টি ফাস্টে আমরা ওদের ঢঙে ঢং ধরি ৷ আমাদের ঈদ, নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ ওরা নেবে ? আমরা ওদের ফ্যাশন নেব, ওদের পোশাক নেব, ওদের পোশাকের ব্র্যান্ড নেব, ওদের সিনেমা দেখবো সিনেমায় যে টুথ ব্রাশ দেখবো সেটাও নেব ৷ ওদের টিভি সিরিয়াল নেব ঝগড়া ঝাটি কূটচাল যা ঘটে তাও আমাদের নিজেদের মাঝে এপ্লাই করবো ৷
আমার মতে যত আমদানি হয় দেশ ততোই দেওলিয়া হয় ৷ প্রাচীন বাংলায় গ্রাম গুলো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ ৷ দুইটা 'ল' ছাড়া আর কিছুই আমদানি করতে হত না ৷ একটা 'ল' হচ্ছে লবন অন্যটি হচ্ছে লোহা ৷ তাই আমাদের দেশের প্রতি পূর্তগীজ ওলন্দাজ আর ব্রিটিশ বণিকদের এতটা আকর্ষণ ছিল ৷
আমার কাছে 'তৃতীয় বিশ্ব' নামটা একটা কলংকের মতো শোনায় ৷ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার ছোট ছোট আর্টিকেল গুলো ভালোই লাগে, মাঝে মাঝে সত্য বলে ফেলে ৷ ঔষধের গায়ে একটা এক্সপেয়ার ডেইট থাকে জানেনিতো ! বড় বড় দেশ যে অস্র বানায় সে গুলোর গায়েও এক্সপেয়ার ডেইট থাকে ৷ ডেইট গুলো এক্সপেয়ার হওয়ার আগে আগে ওরা চায় ওদের অস্র তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোর কাছে বিক্রি করতে অথবা যুদ্ধ বাধিয়ে নিজেরাই প্রয়োগ করতে ৷ ঔষধ কোম্পানির যেমন রিপ্রেজেন্টেটিভ থাকে এসব অস্রের জন্যও থাকে ৷ আমরা না চাইলেও আমাদের যুদ্ধ করতে হয় ৷ এসকল এজেন্টরা যে করেই হউক আমাদের হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাঝে ফাটল ধরাতে তৎপর ৷ আমাদের কৃষ্নাঙ্গ-শেতাঙ্গ নাই, হুতু-তুতসি বিরোধ নেই, হিন্দু-মুসলিমতো আছে ৷ যতদিন আমরা এসব কিনবো ততদিন আমরা আমাদের কলঙ্ক মুছতে পারব না ৷ ভালো কিছু অনুকরণে দোষ নেই ঠিক, কিন্তু মন্দটা না নেয়ার মত বুদ্ধি সততা ত্যাগ দেশপ্রেম কি আছে ? হয়তো আছে...!
বানানে না পরানে
সম্মানী মানুষকে অসম্মান করাটা আমাদের জাতিগত স্বভাব ৷ একটি ফেইসবুক স্টাটাসে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খাঁনের ২৭টি না কয়টি জানি বানান ভুল ৷ ভদ্রলোকের দোষ বানানে না, ভুল করেছেন কাগজ কালি ছেড়ে প্রযুক্তি দিয়ে প্রথম প্রথম লিখে ৷ ভদ্রলোককে চিনি না সুতরাং এটি সম্ভাব্য কারণ, আমার অনুমান ৷ যাদের বানান নিয়ে সারা জীবন দাপট দেখিয়েছেন, আমার বাবার বয়সী শিক্ষকদের মোবাইল কম্পিউটার দিয়ে লিখতে দিলে উনারাও সামান্য হলেও বেকায়দায় পড়বেন ৷ (তবে এ পদে অধিষ্টিত হয়ে সত্যি সত্যি যদি উনার বাংলা বানানের এমন দশা হয় তাহলে বায়ান্নর ভাষা সৈনিকদের নিজের জাত ভাইদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে ৷ )
অনেক দিন আগে আমার জানা এক বাংলা শিক্ষকের বেলায় এমনটি হয় ৷ ভদ্রলোকের দৌড় কতটুকু বলি, পাশাপাশি দুটি স্বরধ্বনি একটি স্বরধ্বনি রূপে উচ্চারিত হলে মিলিত স্বরধ্বনিটিকে বলা হয় যৌগিক স্বর, সন্ধিস্বর, (সান্ধ্যক্ষর বা দ্বি-স্বর ও হতে পারে মনে নাই ) ৷ সন্ধিস্বরের মত এমন কঠিন সব বানান আর উচ্চারণ নিয়ে ভদ্রলোক রীতিমতো গবেষণা করতেন ৷ বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন, কবিতাও লিখতেন ৷ তিনি কাগজে কালিতে লিখতেন, অন্যরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে উনার লেখা প্রকাশ করত ৷ দুর্ভাগ্যক্রমে একবার নিজে নিজে এই কাজটি করলেন ৷ কালি ছেড়ে প্রযুক্তি দিয়ে লিখে নিজের লেখার যখন এমন বেহাল দশা আবিষ্কার করলেন তখন ছেড়ে না দিয়ে বিষয়টাকে চেলেঞ্জ হিসাবেই নিলেন ৷ ভাগ্যিস সে সময় ফেইসবুক ছিলনা পাবলিক নিষ্ঠুর মন্তব্যের সুযোগ পায়নি ৷
আমাদের কথা আমাদের মুখের চাইতে কয়েক গুন বড় ৷ এই বড় কথার অনুশীলন করতে করতে আমরা জাতীয় নেতাদের এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছি যে দেশ ও জাতির জন্য উনাদের অম্লাম অবদান গুলো নিমিষেই ম্লান করে ফেলি ৷ আমরা নিজেদের স্বার্থের বাইরে কাজ, কথা, চিন্তা কিছুই করতে পারিনা ৷ যারা একদিন একজনকে মাথায় তুলেন, হাওয়া বদলের পর তাকেই ছুড়ে ফেলেন ৷
যদি বলা হয় আমাদের জাতীয় নেতাদের জীবনী পড়তে, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস পড়তে, বলি 'তার চাইতে বঙ্কিম চন্দ্রের 'কপাল কুন্ডলা' দেন পইড়া নিজের দাঁত ভাঙি' ৷ উপন্যাসে রস থাকে ইতিহাসে রস নাই, কাউকে পঁচাইলেও রস হয়, সেই পঁচা রসও মজা ৷ এজন্য জাতীয় নেতাই বলেন আর সাধারণ সম্মানী মানুষ বলেন, কাউকে পঁচানোর দৌড়ে সবার আগে আমরা ৷ সব জাত, সব দলই সমান পারদর্শী ৷ আমরা পঁচাইতে ওস্তাদ, তাই তরতাজা মাছের চাইতে আমাদের কাছে সিঁদল শুটকির কদর বেশি ৷
আমার বিস্ময় যখন দেখি সবাই মিলে এক যোগে বয়স্ক মানুষটিকে প্রচণ্ড তিক্ত মন্তব্যের বান ছুড়ছে শিষ্টাচার ভঙ্গের কথা কেউ মাথায় আনছেন না ৷ আমরা এমনই ৷ তাই বলি, সমস্যা উনার বানানে না আমাদের পরানে ?

লন্ডন 

যোগাযোগ

Editor:Sahadul Suhed, News Editor:Loukman Hossain E-mail: news.spainbangla@gmail.com