Latest News

ফটোগ্রাফি ও একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু!

এখলাছ মিয়া:  মাহফুজ, সদ্য আঠারো বছরে পদার্পন করা টগবগে এক তরুন । ছোট বেলা থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি ফটোগ্রাফিতে ছিল তার দারুন জোঁক । নিজ হাতে ছবি তোলা এবং সেগুলোকে পরম যতেœ গ্রাফিক্সে ফুটিয়ে তোলার নেশা তাকে তাড়া করতো প্রতিনিয়ত। এজন্য ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক ও নিজের তৈরী করা ওয়েভসাইট নিজের ডিজাইন করা বিচিত্র হাজারও ছবিতে ছিল পরিপূর্ণ। দূর্দান্ত মাহফুজ শুধু গ্রাফিক্স নিয়েই পড়ে থাকতো না। পড়ালেখায় ছিল অত্যন্ত মেধাবী। তার নিজ হাতে করা কাজগুলো কেউ নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করবেনা এতটুকুন ছেলে এত প্রফেশনালি এত্ত ভাল ফটোগ্রাফি করতে পারে। লেখাপড়ার পাশাপাশি মাস খানেক আগেই কেবল নতুন একটি চাকুরীতে জয়েন করে মাহফুজ । এতদিন হাতে থাকা স্মার্ট ফোন ও কম্পিউটারে ফটোগ্রাফি করে আসলেও তার দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন সে একটি DSLR ক্যামেরা কিনবে । বন্ধুসম আপন বড় ভাই ও ঘনিষ্ট বন্ধুদের প্রায় সবার সাথেই সে DSLR  কেনার আগ্রহের কথা শেয়ার করে । মাসের শেষে হুট করে একদিন নামকরা ব্রান্ডের দামী DSLR  কিনে বাসায় ফেরে মাহফুজ । কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাহফুজ বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে বের হয় । নতুন ক্যামেরায় কত কিছুই ক্যামেরাবন্দী করা হয় । পরে সেগুলোকে ডিজাইন করে বিভিন্ন জায়গায় পোষ্ট করা হয় । পৃথিবীর নানান প্রান্তে থাকা হাজার হাজার ফ্রেন্ডস, ফলোয়ার মাহফুজকে প্রেরণা যুগায়। সবার প্রেরণায় ভাসতে থাকে মাহফুজ!

গ্রীষ্মের এক সোনালী সকাল । চারিদিকে আলো ফুটতেই ঘুম ভাঙ্গে মাহফুজের । আজ তার সাপ্তাহিক ছুটি। ছুটির দিনে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেবার মত ছেলে নয় মাহফুজ। তাড়াহুড়ো করে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বড় ভাইকে সাথে নিয়ে মাহফুজ সকালের নাস্তা করতে বসে। সিরামিকের বড় বাটি ভর্তি দুধ ও কর্ণফ্লেক্স মিশিয়ে কয়েক চামচ মুখে দিয়েই ভাইকে জানায় কাজের জায়গা থেকে সে কিছু টাকা টিপস পেয়েছে। টাকাগুলো কি করবে?  বড় ভাই তাকে পরামর্শ দেয় টাকাটা দিয়ে ব্রান্ডের জুতো কিংবা অন্যকিছু কিনে নিতে। সে বড় ভাইয়ের কথায় রাজী হয়ে বাটি ভর্তি নাস্তা রেখেই স্বভাবজাত হাসি হেসে ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বের হতে চাইলে, বড় ভাই জানতে চায় নাস্তা শেষ না করেই এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছিস?
বন্ধুদের নিয়ে বার্সেলোনা শহরের আর্তিগাস সান্ত আন্দ্রিয়া সমুদ্র সৈকতের আশে পাশে যাচ্ছে বলে ভাইকে জানায় মাহফুজ ।
বন্ধুরা তার জন্য অপেক্ষা করছে একথা বলেই ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে সে ।
আর্তিগাস সান্ত আন্দ্রিয়া। ভূ-মধ্যসাগর পারের নয়ানাভিরাম শহর বার্সেলোনার সমুদ্র সৈকতগুলোর মধ্যে অন্যতম এক সমুদ্র সৈকত । যেখানে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে সব সময়। সমুদ্র সৈকতের ঠিক উপরে গাড়ী চলাচলের রাস্তা এবং তার উপরে ট্রেন চলাচলের রাস্তা বা রেল লাইন । রেল লাইনের উপরে ওভার ব্রিজ রয়েছে যা দিয়ে মানুষ পায়ে হেঁটে চলাচল করতে পারে। ওভারব্রিজের উপর থেকে আঁকা বাঁকা রেল লাইন ও ট্রেনের দ্রুত চলাচল মাহফুজ কে খুব আকৃষ্ট করে । ব্রিজের উপর থেকে কয়েকটা ছবি তোলে মাহফুজ । বেশতো! রেল লাইনের দৃশ্য অসাধারণ লাগছে ছবিতে। ইচ্ছে হয় আরও কিছু ছবি তোলার । সাথে থাকা স্পেনিশ মেয়ে বন্ধুটিকে জানায় সে রেল লাইনের কাছাকাছি যেয়ে আরও কিছু ছবি তুলতে চায়। মেয়ে বন্ধুটি তাকে মানা করে বলে যেকোন সময় ট্রেন চলে আসতে পারে। দুঃসাহসিক মাহফুজ বন্ধুটিকে অভয় দিয়ে বলে, এই খোলা যায়গায় ট্রেন আসলেও দেখতে পারবো, তাছাড়া, তুমি ত আছই । মাহফুজ নীচে নেমে রেল লাইনে দাঁড়ানোর পর মেয়ে বন্ধুটি যেন তার ছবি ও ভিডিও করে এই রিকোয়েস্ট করে সে রেল লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের DSLR  দিয়ে কিছু ছবি উঠায় । ওদিকে মেয়ে বন্ধুটিও তার ছবি উঠানোর দৃশ্য ও ছবি ধারণ করে মোবাইলে। ছবি উঠানো শেষে দুজনই সাথে সাথে ছবিগুলো যার যার ইন্সটাগ্রামে পোষ্ট করে। ছবিগুলো অসসাধারণ হয়েছে! মাহফুজ আরও কিছু ছবি তোলার আগ্রহের কথা বন্ধুটিকে জানায়। বন্ধুটি তাকে মানা করে বলে, থাক আর দরকার নেই, যে কোন সময় ট্রেন চলে আসতে পারে। মাহফুজ আগের মতই অভয় দিয়ে বলে, কিচ্ছু হবেনা তুমি শুধু আমাকে ধারণ করো তোমার মোবাইলে। মাহফুজ ছবি তুলছে। মেয়েটি মোবাইলে ধারণ করছে মাহফুজের ছবি তোলার দৃশ্য। এমন সময় কোথা থেকে হঠাৎ ছুটে আসে দ্রুতগামী ট্রেন! মাহফুজ নিজেকে নিরাপদে সরিয়ে নেবার আগেই মাহফুজের শরীর ট্রেনের ধাক্কায় আঁচড়ে পড়ে রেল লাইনে। মুহুর্তেই মারা যায় মাহফুজ! পুলিশ এসে ছিন্ন ভিন্ন দেহের সাথে গলায় ঝুলে থাকে DSLR ক্যামেরা ও কাঁধে ঝুলানো ব্যাগসহ লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায় পোষ্ট মর্টেম করতে । ওভার ব্রিজের উপর থেকে মেয়ে বন্ধুটি গগন বিধারী চীৎকার করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বার বার মূর্ছা যেতে থাকে । মেয়েটিকে সঙ্গাহীন অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয় । চোখের সামনে প্রিয় বন্ধুটির এমন ভয়ানক মৃত্যু মেনে নিতে পারেনা সে!
মুহুর্তেই মাহফুজের মৃত্যু সংবাদ বার্সেলোনা শহরে ছড়িয়ে পড়লে কমিউনিটিতে শোকের ছায়া নেমে আসে। সবার আদরের মাহফুজের বেড়ে উঠা ছোটবেলা থেকে এ শহরেই। কেউ মেনে নিতে পারেনা এমন আকস্মিক মৃত্যু সংবাদ । মাহফুজের স্কুল ও কলেজের শিক্ষক/ শিক্ষিকা ও সহপাঠিরা মাহফুজের জন্য শোক পালন করতে থাকে । সবার মুখে একটাই কথা, এমন দূর্দান্ত মেধাবী মাহফুজ সবাইকে কাঁদিয়ে এমন অসময় চলে যাবে এটা মেনে নেয়া যায়না !

ঘটনাটি চলতি মাসের ১৬ তারিখের।

যোগাযোগ

Editor:Sahadul Suhed, News Editor:Loukman Hossain E-mail: news.spainbangla@gmail.com